হাড়ের পাহার
এক রাজার দুই ছেলে ছিল। ছোট ছেলের তিনজন বন্ধু ছিল। তাদের মধ্যে একজন হল মন্ত্রীপুত্র, দ্বিতীয় জন কোটালপুত্র আর তৃতীয় জন হল, শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে।
এই চার বন্ধু একে অপরকে খুব ভালবাসত। একদিন তাঁরা ঠিক করল তাঁরা অনেক দূরের দেশে পাড়ি দেবে। এই ভেবে একদিন, এক একজন একটি করে ঘোড়ায় চেপে পাড়ি দিল দূর দেশের উদ্দেশ্যে। ঘোড়ায় চেপে যেতে যেতে প্রায় দুপুর নাগাদ তাঁরা একটি শহর ছাড়িয়ে গভীর জঙ্গলে এসে পড়ল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেখানে এসে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ঘোড়া থেকে নামল। পরিশ্রান্ত ঘোড়াগুলোকে খেতে দিল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তাঁরা আবার ঘোড়ায় চেপে যাত্রা শুরু করল। বেশ খানিকটা যাবার পর তাঁরা আবার বিশ্রাম নেবার জন্য দাঁড়াল। ঘোড়াগুলোকে গাছের পাতা খেতে দিল। নিজেরাও ফলমূল যা পেল তাই খেয়ে কিচ্ছুক্ষণ বিশ্রাম করে আবার চলতে শুরু করল। এইভাবে যেতে যেতে সূর্যাস্তের সময় তাঁরা জঙ্গলের মধ্যে একটি মন্দির দেখতে পেল। তাঁরা ভাবল, “রাতটা এই মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া যাবে”। এই ভেবে তাঁরা সেখানে ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়াগুলিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে নিজেরা মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখল, সেখানে একজন ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী বসে আছেন। সন্ন্যাসী ঐ চার বন্ধুকে দেখতে পেলেন না। সারা জঙ্গল যখন রাতের অন্ধকারে ঢেকে গেল তখন ঐ মন্দির থেকে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পেল। চার বন্ধু ঠিক করল ঐ মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে তাঁরা রাতটা কাটিয়ে দেবে। রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গলের হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা ঠিক করল প্রতি চার ঘণ্টা করে এক একজন পাহারা দেবে আর বাকি তিনজন ঘুমোবে। এইভাবে পাহারা দেবার সময় ব্যবসায়ীর ছেলে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। সন্ন্যাসী মন্দিরে বসে হাতে একটি হাড় নিয়ে কি সব মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। ব্যাবসায়ির ছেলেটি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। এতদূর থেকেও সে পরিস্কার শুনতে পেল সন্ন্যাসী কি মন্ত্র আওড়াচ্ছে। সে চুপচাপ সব শুনতে ও দেখতে থাকল। অবাক হয়ে দেখল মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের চারপাশ থেকে ঠকঠক শব্দ শুরু হল এবং তারই সঙ্গে জঙ্গলের বিভিন্ন দিকে শূন্যে অজস্র হাড় হাওয়ার বেগে বনবন করে ঘুরছে। তারপর হাড়গুলো একত্রিত হয়ে মন্দিরে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ঢিভির মত উচু হয়ে জমা হল। এই দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে বণিকপুত্রের পাহারা দেবার সময় শেষ হল। এইবার কোটালপুত্রের পাহারা দেবার সময় শুরু হল। কোটালপুত্র পাহারা দেবার সময় দেখল সন্ন্যাসী পাহাড়ের মত জমে থাকা হাড়ের সামনে ধ্যানমগ্ন বসে আছেন। যদিও এই হাড়ের বিষয়ে সে কিছুই জানে না। অনেকক্ষণ ধরে কিছুই হল না। সন্ন্যাসী যেমন বসে ছিলেন তেমনি বসে আছেন। রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ছিন্ন করে মাঝে মাঝেই হায়না, হিংস্র নেকড়ে আর গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়া বাঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। কোটালপুত্রের পাহারা দেবার সময় যখন প্রায় শেষ হয়ে এল, সেই সময় ও অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখতে পেল। সন্ন্যাসী ঐ স্তূপাকার হাড়ের ঢিবির সামনে শুয়ে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকলেন। কোটালপুত্র পরিস্কার সে মন্ত্র শুনতে পেল। মন্ত্র উচ্চারণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই হাড়গুলোর মধ্যে থেকে একধরণের আওয়াজ আসতে শুরু করল। পাহাড়ের মত জমে থাকা হাড়গুলো এবার একের পর এক জোড়া লেগে একটি কঙ্কালের আকার নিল। কোটালপুত্র হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। সে এরপর কি হয় তা দেখতে চাইছিল কিন্তু তখনই তার পাহারা দেবার সময় শেষ হয়ে গেল।
এরপর সে মন্ত্রীপুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিজে ঘুমিয়ে পড়ল। বণিকপুত্র যেমন এই ঘটনার ব্যাপারে তাকে কিছু বলে নি, সেও তেমনি মন্ত্রীপুত্রকে এই ব্যাপারে কিছুই বললো না।
page 2
মন্ত্রীপুত্র চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠে পাহারা দিতে শুরু করল। এখন মধ্যরাত। ঠিক এই সময় ভূত প্রেত ও অশুভ আত্মারা চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। এই সময় নেকড়ে ও বাঘের গর্জনও থেমে গেছে। মন্ত্রীপুত্র মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন বসে আছেন এবং তাঁর সামনে কিছু পরে আছে খুব সম্ভবত কোন জন্তুর কঙ্কাল। সে গভীর জঙ্গলের দিকে তাকাল, চতুর্দিকে গহন অন্ধকার, ভয়ে তার চুল খাড়া হয়ে গেল। এইভাবে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে প্রায় তিনঘণ্টা কাটালো। সেই সময় মন্দিরের মধ্যে একটি অদ্ভুত দৃশ্য নজরে পড়ল। সন্ন্যাসী তাঁর সামনে পরে থাকা কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করল। মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কালের শরীর রক্ত মাংসের হয়ে উঠল কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রান ছিল না। রোমহর্ষক সেই দৃশ্য দেখে মন্ত্রিপুত্র তারপর কি হয় দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল কিন্তু ঠিক তখনই তার পাহারা দেবের সময় শেষ হয়ে গেল। মন্ত্রীপুত্র, রাজপুত্রকে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে নিজে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজপুত্র কে মন্ত্রীপুত্র কঙ্কালের ব্যাপারে কিছুই বললো না।
রাজপুত্র যখন পাহারা দিতে শুরু করল তখন দেখল, সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন বসে আছেন। তাঁর সামনে কিছু একটা পরে আছে যা অনেকটা কোন জন্তুর মত দেখতে কিন্তু তার দেহে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। রাজপুত্র অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেবার পর পাহারা দিতে এসে বেশ সুস্থ সবল বোধ করছিল। ক্লান্তির কোন চিহ্ন তার শরীরে ছিল না। সেই ভোরে কিভাবে অন্ধকার একটু একটু করে কেটে গিয়ে আলো ফুটে উঠছিল রাজপুত্র তা বিস্মিত হয়ে দেখছিল। কিন্তু যেই মুহূর্তে পূব দিক থেকে ভোরের লাল আলো ফুটে উঠছিল সেই মুহূর্তে মন্দিরের মধ্যে থেকে একটি শব্দ শুনতে পেল। সেই শব্দ শুনে তার চোখ সন্ন্যাসীর ওপর পড়ল। সন্ন্যাসী তাঁর সামনে পরে থাকা প্রাণহীন প্রাণীর দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করল। যেই মুহূর্তে সন্ন্যাসী মন্ত্র উচ্চারণ করল সেই মুহূর্তে ঐ প্রাণীর দেহে প্রাণের সঞ্চার হল। সে বেঁচে উঠে নিজের পায়ে দাঁড়াল আর সঙ্গে সঙ্গেই একছুটে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। সেই মুহূর্তে কাক ডাকতে শুরু করল আর রাজপুত্রের পাহারা দেবার সময় শেষ হল আর ততক্ষনে তার অন্য তিন বন্ধুও উঠে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই তারা ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা শুরু করল। তারা সবাই আগের রাতে মন্দিরে যা দেখেছিল তা নিয়ে ভাবতে লাগল।
তারা গভীর এবং অভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতেই থাকল। একে অপরের সঙ্গে কেউ কোন কথাই বলছিল না, চুপচাপ নিজেদের ঘোড়া ছুটিয়ে চলতে থাকল। এইভাবে চলতে চলতে দুপুর বেলা তারা বিশ্রাম নেবার জন্য একটি পুকুরের পাশে গাছের ছায়ায় এসে বসল। জঙ্গল থেকে কিছু ফলমূল সংগ্রহ করে সবাই মিলে খেয়ে, পুকুরের জলে তৃষ্ণা মেটাল। রাজপুত্র বলল, “বন্ধুরা, কাল রাতে তোমরা কি মন্দিরে কিছু দেখেছো? আমি তোমাদের বলছি, আমি কি দেখেছি, কিন্তু তার আগে তোমাদের বলতে হবে তোমরা কি দেখেছো। চল, বণিক পুত্র তুমি বল, তুমি কি দেখেছো? কারন কাল রাতে সবার প্রথমে তুমি পাহারায় ছিলে, তাই আগে তুমি বল তারপর একে একে অন্যরা বলবে।
Page 3
বণিকপুত্র বললো, আমি বলবো আমি কি দেখেছি। আমি যখন পাহারা দিচ্ছিলাম তখন আমি দেখলাম, সন্ন্যাসী হাতে একটা হাড় নিয়ে বসে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করলেন যা আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। যেই মুহুর্তে মন্ত্র উচ্চারিত হল সেই মুহূর্তে মন্দিরে চারপাশ থেকে ঠকঠক আওয়াজ উঠল। আর আমি দেখতে পেলাম বিভিন্ন দিক থেকে অনেকগুলো হাড় মন্দিরের দিকে ছুটে আসছে। হাড়গুলো মন্দিরের মধ্যে এসে সন্ন্যাসীর পায়ের সামনে জড়ো হয়ে উচু ঢিবির আকার ধারন করল। আমি কৌতূহলী হয়ে এরপর কি হয় দেখতে চাইছিলাম কিন্তু ঠিক তখনই দেখলাম আমার পাহারা দেবার সময় শেষ হয়ে গেল আর আমি আমার বন্ধু কোটালপুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিজে ঘুমোতে গেলাম। এবার কোটালপুত্র বললো, বন্ধুরা, আমি দেখলাম সন্ন্যাসী পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে থাকা হাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করলেন যা আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মন্ত্র উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই হাড়গুলোর মধ্যে থেকে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, হাড়গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আর একটি হাড় অন্যটির সঙ্গে জোড়া লেগে যাছে। এইভাবে জোড়া লাগতে লাগতে হাড়ের ঢিবিটা একটা কঙ্কালের আকার ধারণ করল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘড়ি জানিয়ে দিল আমার পাহারা দেবার সময় ফুরিয়েছে আর আমি পরের বন্ধু অর্থাৎ মন্ত্রীপুত্রকে ঘুম থেকে তুলে নিজে ঘুমোতে গেলাম। মন্ত্রীপুত্র বললো, পাহারা দেবার সময় আমি দেখলাম, সন্ন্যাসীর সামনে একটি কঙ্কাল পরে আছে, সেই দেখে পাহারা দেবার সময় ঐ তিনঘণ্টা আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তারপর আমি দেখলাম সন্ন্যাসী ঐ কঙ্কালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করছেন যা আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই কঙ্কালের শরীর রক্ত মাংসের হয়ে উঠল কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না তাই নির্জীব হয়ে ওখানেই পরে ছিল। ঠিক তখনই আমার পাহারা দেবার সময় সমাপ্ত হল আর আমি বাধ্য হয়ে পরের বন্ধু রাজপুত্রকে ডেকে দিলাম। আর আমি ঘুমাতে চলে গেলাম। রাজপুত্র বললো, বন্ধুরা, তোমরা যা যা দেখেছো তার থেকে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছো আমি কি দেখেছি। আমি দেখলাম সন্ন্যাসী রক্ত মাংসের নির্জীব শরীরটার দিকে তাকিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করছেন যা আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম। যেই মুহূর্তে মন্ত্র উচ্চারিত হল সেই মুহূর্তে রক্ত মাংসের শরীরটি উঠে দাঁড়াল আর সেটি একটি চমৎকার সুন্দর তেজী হরিণের আকার ধারণ করল। আর আমি যখন মুগ্ধ হয়ে হরিণটিকে দেখছিলাম সেই সময় হরিণটি একছুটে মন্দির থেকে বেড়িয়ে বনের দিকে ছুটে পালাল। সেই মুহূর্তে ভোরের আলো ফুটে উঠল আর কাক ডাকতে শুরু করল আর আমার পাহারা দেবার সময় ফুরিয়ে গেল।
চার বন্ধু একে অন্যের গল্প শুনল। ওরা নিজেদের অভিনন্দন জানাল এমন একটা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হবার জন্য কারন ওদের কোন সন্দেহ রইল না যে, তারা সবাই সন্ন্যাসীর উচ্চারিত মন্ত্র যদি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে তবে ঐ একই ফল পাবে। তারা ঠিক করল, এই অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। যেখানে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছিল সেই গাছের গোঁড়ায় একটি হাড় পরে থাকতে দেখল। সেটা দেখতে পেয়ে তারা ঠিক করল এই হাড়ের ওপরেই পরীক্ষা করে দেখবে। বণিকপুত্র হাড়টি তুলে নিল আর সন্ন্যাসীর মুখে যে মন্ত্র শুনেছিল তা আওড়াতে লাগল। অবাক কান্ড, বিভিন্ন দিক থেকে শয়ে শয়ে হাড় গাছের নিচে জমা হয়ে ঢিবির আকার ধারণ করল। এরপর কোটাল পুত্র একদৃষ্টে ঐ ঢিবির দিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শোনা মন্ত্র উচ্চারণ করল। তারপরেই হাড়গুলোর মধ্যে ঠকঠক আওয়াজ হতে শুরু করল আর হাড়গুলো একসঙ্গে জোড়া লাগতে শুরু করল। এবার জোড়া লাগা হাড়গুলো একটি কঙ্কালের আকার ধারণ করল। ঐ কঙ্কালটি একটি চতুষ্পদ প্রাণীর কঙ্কালের রূপ নিল। এবার মন্ত্রীপুত্র কঙ্কালটির সামনে এসে সেটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সন্ন্যাসীর উচ্চারিত মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করল। এবার কঙ্কালটির দেহে অস্থি মাংস আর চুলের সঞ্চার হল। অবশেষে সেটি ভয়ংকর এবং বিশাল আকারের বাঘের রূপ ধরল।
চার বন্ধু নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। রাজপুত্র কি পারবে সন্ন্যাসীর উচ্চারিত মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করতে? জন্তুটিকে কি জীবিত করে তুলতে পারবে? তাহলে তো এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। তিন বন্ধু এবার রাজপুত্রকে, কঙ্কালটিতে প্রাণের সঞ্চার না করার জন্য অনুরোধ জানাল। কিন্তু রাজপুত্র তাদের অনুরোধে কান দিল না। রাজপুত্র বললো, তোমরা সন্ন্যাসীর কাছ থেকে যে মন্ত্র শুনেছ তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছো। এবার আমি কি করে বুঝবো যে সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শোনা মন্ত্র আমি সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারব কি না? আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে হবেই যে আমার শোনা মন্ত্র আমি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি কি না। আর তাছাড়া এই পরীক্ষা করলেই যে আমাদের প্রাণের ভয় আছে তাও নয় কারন এখানে অনেক বড় গাছ রয়েছে। তোমরা এই গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠে আত্মরক্ষা করতে পারবে আর মন্ত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমিও ঐ গাছে চড়ে যাব। তিনবন্ধুর ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কার কথা কানে না তুলে রাজপুত্র নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। মন্ত্রীপুত্র, কোটাল পুত্র আর বণিকপুত্র গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠে পড়ল আর রাজপুত্র গাছের মাঝামাঝি ডালে চড়ে বসল। রাজপুত্র সেখানে বসেই নির্জীব পরে থাকা বাঘের কঙ্কালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সন্ন্যাসীর মুখ থেকে উচ্চারিত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে গাছে চড়ে গেল। চোখের পলক পরতে না পরতেই বাঘটি সোজা হয়ে দাড়িয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে এক লাফ দিয়ে অদূরে দাঁড়ানো চারটে ঘোড়াকেই মেরে ফেলল। মৃত ঘোড়াগুলির মধ্যে থেকে একটি ঘোড়াকে টানতে টানতে গহন জঙ্গলের দিকে চলে গেল। গায়ের রক্ত জল করা এই দৃশ্য দেখে চার বন্ধু গাছের ডালে শ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ লুকিয়ে রইল। বিপদ বিদায় হয়েছে; বাঘটি তাদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ ঐভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকার পর তারা গাছ থেকে নিচে নেমে এল। একটিও ঘোড়া না থাকার জন্য তারা বাধ্য হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেটে রওনা দিল। জঙ্গলের রাস্তা পার করে তারা একটি সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছাল। ক্লান্ত হয়ে তারা সমুদ্র দিয়ে কোন জাহাজ যাবে এই আশায় সাগর তটে বসে রইল। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভাগ্যক্রমে একটি নৌকো ভেসে আসতে দেখল। তারা রুমাল নাড়িয়ে নৌকোতে থাকা মানুষদের নজর কাড়ার সবরকম চেষ্টা চালাতে লাগল। অবশেষে নৌকোর চালক আর অন্যান্য কর্মীরা তাদের দেখতে পেল। তারা কিনারায় এসে চারবন্ধুকে নৌকোয় তুলে নিল কিন্তু একটা শর্তে চালক তাদের নৌকোয় তুললো যে নৌকোয় বেশি জায়গা নেই তাই বেশিদূর তাদের নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই প্রথম যে উপকূল পাবে সেখানেই তাদের নামিয়ে দেওয়া হবে।
চার পাঁচ দিন একটানা সমুদ্রে পাড়ি দেবার পর কিনারায় উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর চূড়া নজরে এল হয়ত কোন বড় শহর হবে এই ভেবে চার বন্ধুকে সেখানেই নামিয়ে দেওয়া হল।
চার বন্ধু পাড়ে এসে দুধারে গাছের সারি দেওয়া রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার শেষে একটি বাজারে এসে পৌঁছাল। ঐ বাজারে শ’য়ে শ’য়ে দোকান ছিল কিন্তু অবাক কান্ড তাতে কোন মানুষ ছিল না। ওখানে দোকান ভর্তি কেক, বিস্কিট, মিষ্টি ছিল অথচ বিক্রি করার জন্য কেউ ছিল না। সেখানে একটি কামারের দোকান ছিল। সেখানে কামারের নেহাই, হাঁপর ইত্যাদি সব যন্ত্রপাতি মজুদ ছিল কিন্তু কামার ছিল না। ওখানে আরও অনেক দোকান ছিল যাতে শুকনো সব্জি রাখা ছিল কিন্তু বিক্রির জন্য কোন মহিলা বা পুরুষ ছিল না। রাস্তাগুলো ছিল জনমানবহীন। কোন মানুষ বা গরু বাছুরের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। গরুর গাড়ি ছিল কিন্তু গরু ছিল না, ঘোড়ার গাড়ি ছিল কিন্তু ঘোড়া ছিল না। রাস্তার দুধারে বাড়ি ঘরের দরজা জানলা সব খোলা কিন্তু তাতে কোন মানুষজন নেই। মনে হচ্ছে একটা জনমানবহীন শহর।
মনে হচ্ছে এটি একটি মৃত শহর। চার বন্ধু অবাক হয়ে গেল। ঐ দৃশ্য দেখে তারা খুব ভয় পেয়ে গেল। আর একটু এগিয়ে যাবার পর খুব সুন্দর একটি অট্টালিকা দেখতে পেল। যা রাজপ্রাসাদ বলে মনে হল। তারা গেট খুলে ভিতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকে এক কুঠুরীতে গিয়ে দেখল ঢাল, তলোয়ার এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র রাখা আছে কিন্তু সৈন্য সামন্ত কেউ নেই। এবার এক পা এক পা করে অন্দরের দিকে যেতে শুরু করল কিন্তু কোন প্রহরী বা কোন মানুষের চিহ্ন দেখতে পেল না। তারা ঘোড়াশালে গেল, গিয়ে দেখল প্রচুর পরিমানে খাবার পাত্র, ঘাস, শস্য সব নিচে পরে আছে কিন্তু কোন ঘোড়া নেই। তারা প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করল। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে গেল কিন্তু কোন মানুষের চিহ্ন পেল না। ওরা ৬টি ভবন পেরিয়ে গেল কিন্তু কাউকে চোখে পড়ল না। এবার সপ্তম ভবনটি সামনে এসে দাঁড়াল আর এই প্রথম মানুষের দেখা পেল। তারা দেখল চার জন অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা এসে চারজন চার বন্ধুর হাত ধরে প্রত্যেক রাজকন্যা যার হাত ধরল তাকে নিজের স্বামী বলে ডাকল। রাজকন্যারা বললো, তারা অনেক দিন ধরে এই চার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের আগমনে রাজকন্যাদের খুশি আর ধরছিল না। রাজকন্যারা তাদের চারজনকে অন্দর মহলে নিয়ে গেল এবং সেখানে গিয়ে তাদের নানান রকমের সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করল। সেখানে কোন দাসদাসী ছিল না, রাজকন্যারা নিজেরাই সব কিছু পরিবেশন করছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর রাজকন্যারা বললো, নির্জন, নিঝুম, জনমানুষহীন এই রাজপুরীর বিষয়ে কোন প্রশ্ন করা চলবে না। এর পর প্রত্যেক রাজকন্যা তাদের নিজেদের নতুন নতুন স্বামীকে নিয়ে নিজের নিজের ভবনে চলে গেল। নিজেদের ভবনে যাবার পর রাজকন্যা কাঁদতে লাগল। রাজপুত্র কান্নার কারণ জানতে চাইলে রাজকন্যা বললো, রাজপুত্র, আমার খুব করুণা হচ্ছে তোমার জন্য। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোন রাজপুত্র এবং তোমার হৃদয়ও রাজপুত্রের মত বিশাল। তাই আমি তোমাকে আমার সব কথা শোনাব আর আমার তিন সঙ্গিনী যারা রাজকন্যার মত দেখতে তাদের গল্পও শোনাব। আমি একজন রাজার মেয়ে। এই প্রাসাদটি আমার বাবার। আমার এই তিন সঙ্গিনী যারা রাজকন্যার মত সাজ পোশাক পরেছে আর যারা তোমার তিন বন্ধুকে স্বামী বলছে তারা আসলে রাক্ষসী। বেশ কিছুদিন আগে তারা এই শহরে আসে। তারা এই রাজ্যের রাজা আমার বাবা, রানী আমার মা, আমার অনেক ভাইবোনদের খেয়ে ফেলেছে। রাজার মন্ত্রী এবং দাসদাসীদেরও খেয়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে তারা এই শহরের বাকি মানুষজনদেরও খেয়ে ফেলল। আমার বাবার হাতি, ঘোড়া, এই শহরের সব গরু বাছুর সব খেয়ে ফেলেছে। তুমি এই প্রাসাদে আসার সময় নিশ্চয়ই দেখেছো যে রাস্তায় কোন লোকজন বা কোন গরু বা জ্যান্ত প্রাণী কিছুই নেই। এই তিন রাক্ষসী তাদের সবাইকে খেয়ে ফেলেছে। তারা শুধু আমাকে জীবিত রেখেছে। হয়ত অল্প কিছু সময়ের জন্য, তারপর তারা আমাকেও খেয়ে ফেলবে। এই রাক্ষসীরা যখন দূর থেকে তোমাদের আসতে দেখল, তখন তারা খুব খুশি হয়ে উঠল কারন তারা ক’দিন বাদেই তোমাদের সবাইকে খেয়ে ফেলবে।
রাজপুত্র বললো, তাই যদি হয় তাহলে আমি কি করে বুঝবো যে তুমি নিজেও একজন রাক্ষসী নও। হতে পারে তুমিও আমাকে খেয়ে ফেলবে।
রাজকন্যা বললো, আমি তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলবো যাতে তুমি বুঝতে পারবে যে ওরা তিনজন রাক্ষসী আর আমি রাক্ষসী নই। তুমি নিশ্চয়ই জানো যে সাধারণ মানব মানবীদের তুলনায় রাক্ষসীরা হাজার গুন বেশি পরিমাণে খায়। রাক্ষসীরা আমাদের সঙ্গে টেবিলে বসে খায় তাতে তাদের খিদে মেটে না। তাই তারা রাত্রে বাইরে বেড়িয়ে মানুষ অথবা অন্যান্য জন্তু জানোয়ারের খোঁজে অনেক দূরে দূরে যায় কারন এই শহরের কোন প্রাণীই আর অবশিষ্ট নেই। রাক্ষসীরা সবাইকে খেয়ে ফেলেছে। তুমি তোমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারো যে তাদের স্ত্রীরা সারারাত ওদের কাছে থাকে কিনা। দেখবে তারা ঠিক বলবে যে, তাদের স্ত্রীরা রাতের বেলায় অনেকটা সময় বিছানায় থাকে না। কিন্তু তুমি দেখো আমি সারারাত তোমার পাশেই থাকবো। কিন্তু খুব সাবধান, রাক্ষসীরা যেন এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে। একবার যদি ওরা এই ব্যাপারে কিছু টের পায় তবে তারা প্রথমেই আমাকে শেষ করবে তারপর তোমাদের সবাইকে গিলে ফেলবে।
পরের দিন রাজপুত্র, কোটাল পুত্র, মন্ত্রীপুত্র আর বণিকপুত্রকে ডেকে একসঙ্গে খুব গোপনে মিলিত হয়ে রাজকন্যার থেকে যা যা শুনেছে তার সবটুকু তাদের জানালো আর তাদের অনুরোধ করল যাতে তারা রাতে ঘুমের ভান করে জেগে যেন লক্ষ্য রাখে তাদের স্ত্রীরা কি করছে। তারা কি রাতে বাইরে চলে যাচ্ছে নাকি ঘরের মধ্যেই থাকছে? একটা ব্যাপার তারা সবাই লক্ষ্য করেছে যে, এই ভান করা রাজকন্যারা সারাদিন ঘুমিয়ে থাকে, আর রাজপুত্রের স্ত্রী সারাদিনে একফোঁটাও ঘুমায় না। যথারীতি তিনবন্ধু যে যার শয্যায় ঘুমের ভান করে পরে রইল। তারা এমন ভান করল যে মনে হবে তারা গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে রয়েছে। রাত যখন গভীর হল তখন তাদের স্ত্রীরা স্বামীদের গভীর ঘুমে আছন্ন আছে ভেবে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল আর সারারাত ফিরল না। খুব ভোরে আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এইভাবে রোজ তিন বন্ধুর স্ত্রীরা সারাদিন ঘুমিয়ে থেকে সন্ধ্যেবেলা ঘুম থেকে উঠত। দুইদিন এবং তিনরাত তিন বন্ধু এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করল। রাজপুত্রও সারারাত ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকত এবং স্ত্রীর দিকে নজর রাখত। কিন্তু রাজকন্যা এক মুহূর্তের জন্যও রাতে ঘরের বাইরে যেত না এবং দিনের বেলা ঘুমিয়েও থাকত না। এই ঘটনার পর রাজপুত্রের বন্ধুরা সন্দেহ করতে শুরু করল যে, রাজপুত্রের কথাই সত্যি। তাদের স্ত্রীরা সত্যিই রাক্ষসী। ইতিমধ্যে রাজকন্যা রাজপুত্রকে জানাল যে, রাক্ষসীরা মানুষ ও জন্তুর মাংস খেয়ে তাদের হাড়গোড়গুলি শহরের উত্তর দিকে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় আর সেখানে মানুষ ও জন্তু জানোয়ারের হাড়ের পাহাড় হয়ে গেছে। তারপর একদিন রাজপুত্র আর তার তিন বন্ধু সত্যিই সেখানে হাড়ের পাহাড় জমেছে কিনা তা যাচাই করতে শহরের উত্তর প্রান্তে গেল। গিয়ে দেখল সত্যিই সেখানে মানুষ আর জন্তু জানোয়ারের হাড়ের পাহাড় জমে আছে। এই দেখে তার নিশ্চিত হয়ে গেল যে ঐ তিনজন সত্যিই রাক্ষসী।
এখন প্রশ্ন হল এই রাক্ষসীদের হাত থেকে কি করে রেহাই পাওয়া যায়? চার বন্ধুর জন্য সবচেয়ে ভাল কথা এই যে, রাক্ষসীরা সারা সকাল ঘুমিয়ে থাকে তাই রাক্ষসীদের হাত থেকে কি করে রেহাই পাওয়া যায় তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করার জন্য অনেক সময় ওরা পেয়ে যাবে। রাজকন্যা তাদের বললো যে, সমুদ্র তটে গিয়ে দেখো যদি কোন জাহাজের সন্ধান পাওয়া যায়। তার কথা মত চার বন্ধু সমুদ্রের ধারে গিয়ে অপেক্ষা করে যদি সেই পথে কোন জাহাজ দেখতে পাওয়া যায়। তারা সবসময় রাজকন্যাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেত। রাজকন্যা যাবার সময় অলঙ্কার, সোনাদানা, মূল্যবান পাথর সব একটি পুটলিতে করে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেত। এইভাবে অপেক্ষা করার পর একদিন তারা অনেক দূর থেকে একটি জাহাজকে আসতে দেখল। জাহাজটিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তারা নাবিকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগল। জাহাজের নাবিক তা দেখতে পেয়ে সমুদ্রের ধারে এল। আসার সঙ্গে সঙ্গে চারবন্ধু আর রাজকন্যা জাহাজে চড়ে বসল। রাজকন্যা নাবিককে অনুরোধ করল তাদের নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য আর তার বিনিময়ে রাজকন্যা নাবিককে অনেক টাকাপয়সা দেবার প্রতিশ্রুতি দিল কারন রাজকন্যা জানে সন্ধ্যে হলেই রাক্ষসীদের ঘুম ভাঙ্গবে আর যদি ঐ সময়ের মধ্যে জাহাজটি সমুদ্র তট থেকে আট মাইলের মধ্যেও থাকে তবুও রাক্ষসীরা জাহাজের নাবিক আর অন্যান্যদের মেরে ফেলতে পারবে কারন দশ যোজন দূরের মানুষ বা পশুদের খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাক্ষসীদের আছে। তাই জাহাজ তাড়াতাড়ি চালাবার জন্য চারবন্ধু আর রাজকন্যা, নাবিক আর মাল্লাদের উৎসাহ দিতে লাগল যাতে তারা হাওয়ার বেগে জাহাজ চালাতে সক্ষম হয়। ঠিক সূর্যাস্তের সময়, সমুদ্র তট থেকে ভয়ঙ্কর এক গর্জন শোনা গেল। রাক্ষসীরা ঘুম থেকে উঠে চারবন্ধু আর রাজকন্যাকে দেখতে না পেয়ে ধরেই নিল যে নিশ্চয়ই তারা জাহাজে করে পালাবার চেষ্টা করেছে। তাই সময় নষ্ট না করে রাক্ষসীরা বিদ্যুতের গতিতে সমুদ্রের ধারে ধেয়ে এল। আর জাহাজটিকে দেখতে পেয়েই তাদের লম্বা লম্বা হাত বাড়িয়ে জাহাজটিকে ধরতে চাইল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে জাহাজটি ততক্ষনে সমুদ্র তট থেকে আশি মাইলেরও বেশি দূরে চলে গেছিল। কিন্তু রাক্ষসীরা তাদের লম্বা লম্বা হাত, এত বড় বড় চোয়াল বাড়িয়ে জাহাজটিকে প্রায় হাতের মুঠোয় এনে মুখে পুরে দেবার চেষ্টা করছিল কিন্তু একটুর জন্য তা হয়ে উঠল না। জাহাজটি তাদের নাগালের বাইরে বেড়িয়ে গেল। জাহাজের নাবিক ও অন্য সবাই শুনতে পেল রাক্ষসীরা চিৎকার করে বলছে, “ ও আমাদের বোন রে, তোর পেটে পেটে এত বুদ্ধি ছিল? তুই আমাদের ফেলে একা একাই সবাইকে খেয়ে নেবার ফন্দী এঁটেছিস”? যেই না একথা শুনেছে, অমনি মন্ত্রীপুত্র, কোটাল পুত্র আর বণিকপুত্র ভাবল এই রাজকন্যাও কি তাহলে আসলে রাক্ষসী? শুধু রাজকন্যার ছদ্মবেশ ধরে আছে? রাক্ষসীদের কথা শুনে তারা ভাবল, তাহলে নিশ্চয়ই রাজকন্যাও রাক্ষসীই হবে। রাক্ষসীদের কথা শুনে রাজপুত্রের মনে কোনই সন্দেহ জাগল না কারন রাজপুত্র নিশ্চিত ছিল যে, রাজকন্যা রাক্ষসী হতেই পারে না। জাহাজের নাবিক তাদের বললো যে, তারা জাহাজ নিয়ে সোনার খনির সন্ধানে অনেক দূরের দেশে পাড়ি দিয়েছে তাই চার বন্ধু ও রাজকন্যাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই রাত ফুরিয়ে গেলেই তাদের কাছাকাছি কোন বন্দরে নামিয়ে দেবে। পরের দিন অনেক রাস্তা পার হবার পরেও কোন বন্দরের দেখা পাওয়া গেল না। যেতে যেতে সন্ধ্যে নাগাদ একটি বন্দরের দেখা মিললো। নাবিক তাদের সেই সমুদ্রের ধারে নামিয়ে জাহাজ নিয়ে চলে গেল। অভ্যেস না থাকার দরুন পায়ে হেটে কিছুদূর চলার পর রাজকন্যা খিদে ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। তখন তারা সবাই একটি গাছের নিচে বসল। রাজপুত্র বণিকপুত্রকে কাছের বাজার থেকে ফল মিষ্টি কিনে আনার জন্য পাঠালেন। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বনিকপুত্র ফিরল না কারন বণিকপুত্র ধরেই নিয়েছিল যে, যাদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে রাজকন্যাও তাদের মতই এক রাক্ষসী। বনিকপুত্রের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে রাজপুত্র কোটালপুত্রকে পাঠাল কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও সে ফিরল না কারন বণিকপুত্রের মত কোটাল পুত্রও বিশ্বাস করল যে রাজকন্যা রাক্ষসী। এরপর মন্ত্রীপুত্রকে পাঠানো হল কিন্তু বাকি দুই বন্ধুর মত সেও ফিরে এল না। তাদের ফিরতে না দেখে রাজপুত্র এবার নিজেই গেলেন। গিয়ে দেখলেন তিন বন্ধুই মিষ্টির দোকানে বসে আছে। তারা রাজপুত্রকে অনেক বোঝালো যে রাজকন্যা আসলে রাক্ষসী। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তারা রাজপুত্রকে তাদের সঙ্গে নিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে এল।
একা একা রাজকন্যা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হাঁটতে হাঁটতে নিজেই বাজারে চলে এল। এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে একা একা কি করবে, কোথায় যাবে ভেবে কোন কূল কিনারা পেল না। তারপর সেখানে এক দরিদ্র মহিলার বাড়ি কয়েকটা দিনের জন্য আশ্রয় পেল। রাজকন্যা, রাজপুত্রের কাছ থেকে তারা কোথায় থাকে, কি তাদের শহরের নাম কথায় কথায় সে সব কিছুই জেনেছিল । খুঁজে খুঁজে সেই শহরে এসে রাজকন্যা তার কিছু গয়নাগাটি বিক্রি করে নিজের থাকার জন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করল। ছোট বেলা থেকেই পাশা খেলায় রাজকন্যে পারদর্শী ছিল। ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। তাই তার সঙ্গে পাশা খেলার জন্য শহরের সব পাশা খেলোয়াড়দের সে চ্যালেঞ্জ জানাল। খেলার শর্ত ছিল যে তাকে হারাবে তাকে নগদ ৫ লাখ টাকা দেবে আর যদি রাজকন্যা হেরে যায় তবে তাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে। রাজকন্যা সে দেশের রাজার কাছ থেকে অনুমতি নিল যে, যদি কেউ হেরে যায় আর শর্ত অনুযায়ী টাকা না দিতে পারে তবে রাজকন্যা তাকে নিজের বাড়িতে বন্দী করে রাখবে।বণিকপুত্র, কোটালপুত্র আর মন্ত্রীপুত্র তিনজনেই আশ্চর্য এই খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলে অনেক টাকা জিতে নেবার স্বপ্ন দেখল কিন্তু রাজকন্যার সঙ্গে খেলে বারবার হারতে হারতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়াল যে আর টাকা দেবার ক্ষমতা ওদের রইল না আর শর্ত অনুযায়ী রাজকন্যা তাদের নিজের বাড়িতে বন্দী করে রাখল। শেষে রাজপুত্র খেলার প্রস্তাব দিল। রাজকন্যা ইচ্ছে করে প্রথম চালে রাজপুত্রকে জিততে দিল। একবার জিতে আবার জেতার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠলো। কিন্তু তারপর থেকে বারবারই হেরে যেতে থাকল। যত হারতে থাকল রাজপুত্রের জেতার নেশা ততই চেপে বসল। আর এইভাবে বারবার খেলে হারতে হারতে এমন অবস্থায় দাঁড়াল যে রাজপুত্রের আর টাকা দেবার ক্ষমতা রইল না। শর্ত অনুযায়ী রাজপুত্রকে টানতে টানতে তার বন্ধুদের সঙ্গে এনে বন্দী করা হল। এবার রাজকন্যা তাদের সামনে নিজের আসল পরিচয় দিল। রাজকন্যা এবার সবাইকে মুক্ত করল। সব শুনে বনিকপুত্র, কোটালপুত্র, মন্ত্রিপুত্র আর রাজপুত্রের আনন্দ আর ধরে না। রাজা ও রানী রাজকন্যাকে নিজেদের ছেলে বউকে মহা ধুমধামের সঙ্গে বরন করে নিলেন। প্রাসাদের সবাই নতুন বউকে পেয়ে খুব খুশি। রাজকন্যা নিজের মা-বাবা, ভাইবোনদের কথা ভুলতে পারছে না। শুধুই মনে হচ্ছে রাক্ষসীরা তাদের খেয়ে তাদের হাড়গোড় ছুড়ে ফেলে দিয়েছে আর তা প্রাসাদের বাইরে পাহাড়ের মত জমে রয়েছে। রাজপুত্র তখন তাকে বললো তাদের চার বন্ধুর সেই হাড়ের পাহাড় থেকে তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। তারা রাজকন্যার বাবা মা আর অন্যদের হাড়গোড় একত্র করে তাতে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে ঐ তিন রাক্ষসীকে কি করে মারা যায়? সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তারা হাড়ে প্রাণ সঞ্চার করা তো শিখেছে কিন্তু রাক্ষসীদের কি করে মেরে ফেলা যায় তা জানে না। রাজকন্যা আর চারবন্ধু একদিন সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করার জন্য গভীর জঙ্গলের ঐ মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তারা সন্ন্যাসির সঙ্গে দেখা করে তার কাছে দূর থেকে রাক্ষসীদের মারার মন্ত্র শিখিয়ে দেবার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করল। শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী তাদের আশীর্বাদ করলেন এবং মরণবান ছোড়ার মন্ত্র সেখাতে সম্মত হলেন। সেই সময় সেখান দিয়ে একটি হরিণ যাচ্ছিল। সন্ন্যাসী এক মুঠো জল নিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করলেন যা রাজপুত্র স্পষ্ট শুনতে পেলেন। এবার মন্ত্রপূত জল নিয়ে ঐ হরিণের ওপর ছিটিয়ে দিলেন। হরিণটি মুহূর্তের মধ্যে মারা পড়ল। এবার সন্ন্যাসী আরও কিছু মন্ত্র পড়ল আর হরিণটি সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে উঠে এক লাফে জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাল।
মারণবান মন্ত্র পেয়ে রাজপুত্র, রাজকন্যা আর তিনবন্ধুকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। যেই না তারা ঐ মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করল ওমনি তিন রাক্ষসী হাঁউ মাঁউ খাঁউ করে তাদের বিশাল বিশাল হাত বাড়িয়ে সবাইকে খাবার জন্য ছুটে এল। রাজপুত্র সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রপূত জল রাক্ষসীদের ওপর ছিটিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসীরা মারা পড়ল। এরপর তারা সবাই হাড়ের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। বনিকপুত্র মন্ত্র পরে হাড়গুলোকে একত্রিত করল। কোটালপুত্র মন্ত্র পরে এগুলিকে কংকালে পরিণত করল আর মন্ত্রীপুত্র মন্ত্র পাঠ করে তাদের শরীরে রক্ত মাংসের আবরণ তৈরি করল। আর শেষ পর্যন্ত রাজপুত্র সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শেখা মন্ত্র উচ্চারণ করে তাদের শরীরে প্রাণের সঞ্চার করল। রাজকন্যা, বাবা মা আর অন্যান্যদের বেঁচে উঠতে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো। তারপর সবাই মিলে প্রাসাদে ফিরে গিয়ে খুব হৈচৈ করে কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কাটিয়ে রাজকন্যা, রাজপুত্র আর তার তিনবন্ধুরা নিজেদের দেশে ফিরে গেল। সেখানে ফিরে সবাই মনের সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।