টাকমাথা বউ
এক বনিকের দুটো বউ ছিল। বড় বউয়ের থেকে ছোট বউকে সে বেশি ভালবাসত। ছোট বউের অনেক চুল। সে তার চুলে দুটো বেনুনি বাঁধত আর বড় বউয়ের মাত্র এক গোছা চুল ছিল। একদিন সেই বনিক ব্যবসার কাজে অনেক দূরের শহরে গেল। বাড়িতে কেবলমাত্র দুই বউই রইল। তারা একে অপরকে খুব ঘেন্না করত। স্বামী সোহাগিনী ছোট বউ, বড় বউয়ের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত। তাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজকর্ম করাতো, সারা দিনরাত তাকে শুধুই বকাবকি করত। পেট ভড়ে খেতেও দিত না।
একদিন ছোট বউটি বড় বউ কে বলল, “এসো, আমার চুল থেকে সব উকুন বেছে দাও”। বড় বউ তার কথা শুনে ছোট বউয়ের চুল থেকে উকুন বাছতে শুরু করল তখন হটাত কিছু চুল ছিঁড়ে গেল। আর তারপর ছোট বউ রেগে আগুন হয়ে বড় বউয়ের একটি মাত্র চুলের গোছা টেনে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর তাকে বাড়ি থেকে দূর দূর কর তাড়িয়ে দিল। বড় বউ এর মাথায় একটাও চুল রইল না। এইবার মনের দুঃখে ও ভাবল বনে চলে যাব। সেখানে গিয়ে হয় না খেতে পেয়ে মরে যাব; তা নাহলে কোন হিংস্র জন্তুর হাতে মারা পরব।
যেতে যেতে সে একটা তুলোর গাছ দেখতে পেল। একটু আরাম করার জন্য ও সেই গাছের নিচে বসল। ওখানে কিছু কাঠি পড়েছিল। ওগুলোক একসঙ্গে করে ও নিজের জন্য একটা ঝাড়ু বানালো। এবার ঐ ঝাড়ু দিয়ে গাছের নিচে পরে থাকা শুকনো পাতা, ময়লা সব ঝেড়ে ভাল করে পরিস্কার করল। তা দেখে তুলো গাছ খুব খুশি হয়ে ওকে আশীর্বাদ করল। এবার সেখান থেকে বেরিয়ে সে আবার পথ চলতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পরই একটি কলা গাছ দেখতে পেল। এবার সে ঝাড়ু দিয়ে ঐ গাছের নিচে পরে থাকা সব নোংরা পরিস্কার করে দিল। ওর দয়ামায়া দেখে খুব খুশি হয়ে কলা গাছও তাকে খুব আশীর্বাদ করল।
চলতে চলতে কিছুদূর গিয়ে সে দেখল একটি গোয়াল ঘর। জায়গাটা খুব নোংরা ছিল। ও খুব যত্ন করে গোয়াল ঘরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে দিল। খুশি হয়ে তাকে ব্রাহ্মণী ষাঁড় আশীর্বাদ করল। এরপর রাস্তায় যেতে একটি তুলসী গাছ দেখে ভক্তিভরে সেখানে প্রণাম করল। তারপর তুলসী বেদীর চারধার খুব যত্ন করে পরিস্কার করল। এবার তুলসী তাকে আশীর্বাদ করলেন।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটি কুঁড়ে ঘর দেখতে পেল। ঘরটি গাছের ডালপালা আর পাতা দিয়ে তৈরি। একজন ঋষি সেখানে বসে ধ্যান করছিলেন। সেখানে গিয়ে একমুহুর্ত ঐ সাধুর পেছনে দাড়িয়ে রইল। তখন ঋষি বললেন, “তুমি যেই হও না কেন, সামনে এসো। আমার পেছনে দাড়িয়ে থেকো না। তাহলে আমি তোমাকে ভস্ম করে দেব”। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঋষির সামনে এসে দাঁড়াল। ঋষি বললেন, “কি চাও”? সে বললো, “পিতা, আপনি জানেন আমি কত দুঃখী। আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে না আর ওনার অন্য স্ত্রী আমার একটিমাত্র চুলের গোছা ছিঁড়ে দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। পিতা আমাকে দয়া করুন”।
ঋষি কিছুক্ষণ চুপচাপ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইলেন, তারপর বললেন, অদূরে ঐ যে জলাশয় দেখছো সেখানে যাও, সেখানে গিয়ে ঐ পুকুরের জলে একবারমাত্র ডুব দিয়ে উঠে আমার কাছে এসো।
মেয়েটি ঋষির কথামত ঐ পুকুরের জলে একটিমাত্র ডুব দিয়ে উঠে পড়ল। জল থেকে উঠার পর নিজের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। একি! একমাথা ভর্তি কুচকুচে কালো চুল।এত লম্বা চুল যে তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সেই ঘন কালো কেশদাম। আর তার গায়ের রঙও ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে। তাকে দেখতে অনেক সুন্দরী লাগছে আর বয়সও অনেক কমে গেছে। খুব খুশি হয়ে শ্রদ্ধা সহকারে ঋষির কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করল। ঋষি বললেন, “উঠো, ভেতরে যাও গিয়ে দেখবে কয়েকটা ঝুড়ি আছে, সেখান থেকে যেটা খুশি সেটা নিয়ে এসো”। ও ভেতরে গেল, গিয়ে সাধারণ দেখতে একটা ঝুড়ি নিয়ে এল। এবার ঋষি ওকে বললেন, “ওটা খোলো”। ঝুড়িটা খুলে বড় বউ তো হতবাক! একি ঝুড়ি ভর্তি সোনাদানা, মনিমুক্তো, দামী দামী পাথর। ঋষি বললেন,“যাও, এটা নিয়ে বাড়ি যাও। এর থেকে যত খুশি খরচ কর, দেখবে যতই খরচ কর না কেন, এটা কখনও খালি হবে না। যত নেবে ততই আবার ভড়ে যবে। যাও, সুখে শান্তিতে সংসার কর”। বড় বউ ঋষিকে প্রণাম করে বাড়ির পথে রওনা দিলেন।
ঝুড়িটা হাতে করে বাড়ির পথে ফেরার সময় যে তুলসী বেদীর নিচে ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করেছিল সেই তুলসী বেদীর সামনে এসে পৌঁছাল। তুলসী বললেন, “যাও সুখে ঘর কর, তোমার স্বামী তোমাকে খুব ভালবাসবেন”। সেখান থেকে বেড়িয়ে ও গোয়ালের সামনে দিয়ে যাবার সময় ব্রাহ্মণী ষাঁড় তাকে সিং দিয়ে বানানো দুটো বালা দিয়ে বললো, “শোন মেয়ে, এই দুটো বালা তুমি তোমার হাতে পরে থাকবে এবং যখনই তুমি যেকোন একটি বালা ধরে নাড়াবে তখনই তুমি যা গয়না চাইবে তাই পাবে”। তারপর সে কলা গাছের সামনে এল। কলাগাছ তাকে খুব বড় একটা পাতা দিয়ে বললো, “মা,এই পাতাটা নিয়ে যাও। যখনই এটা ঘোরাবে তখনই তুমি সুস্বাদু ফল সব্জি এবং যে খাবার তুমি খেতে চাও তাই পাবে”। এরপর ও তুলো গাছে সামনে এল। তুলো গাছ তাকে নিজের একটি ডাল দিয়ে বললো, “ মা আমার, এই শাখাটি নিয়ে যাও এবং যখনই তুমি একে নাড়াবে তখনই সূতির কাপড়ই শুধু নয় সিল্ক এবং অন্য ধরণের কাপড়ও পাবে। এবার আমার সামনেই এটিকে নাড়াও তো”। যেই না সে গাছের ডালটি ধরে নাড়ালো, অমনি মসৃণ সিল্কের কাপড় তার হাতে চলে এল। ও সেই সিল্কের শাড়ি ও হাতে বালা পরে, ঝুড়ি ও গাছের ডাল নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল।
বাড়ি ফিরে দেখলো ছোট বউ দরজায় দাড়িয়ে আছে। এত সুন্দরী একজন মহিলাকে দেখে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। একি! কাকে দেখছে? কুৎসিত, টেকো বড় বউ রূপসী রানীর মত দেখতে হল কি করে? ধনী, রূপসী বড় বউ ছোট বউকে সহানুভূতির চোখে দেখছে। সে তার ভালো ভালো জামাকাপড়, দামী দামী গয়না, নানান খাদ্য সামগ্রী সব কিছু ছোট বউয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইল। কিন্তু কোন লাভ হল না। বড় বউয়ের রূপ, এক ঢাল কালো চুল দেখে ছোট বউয়ের খুব হিংসে হল। এসব কিছু ও জংগলে গিয়ে ঋষির কাছ থেকে পেয়েছে শুনে ছোট বউ ঠিক করল সেও সেখানে যাবে।
যেই না ভাবা অমনি ছোট বউ জংগলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাবার পথে তুলো গাছের সামনে দিয়ে গেল কিন্তু কিছুই করল না। এভাবে ও একে একে কলা গাছ, ব্রাহ্মণী ষাঁড়, তুলসী বেদী এসবের সামনে দিয়ে হেটে চলে গেল কিন্তু কারুর কোন উপকারে এল না। অবশেষে চলতে চলতে ও ঋষির সামনে এসে দাঁড়াল।
ঋষি ওকে পুকুরে স্নান করতে বললেন এবং সাবধান করে দিলেন যেন একবার মাত্র ডুব দেয় তার বেশি নয়। পুকুরের জলে নেমে ও একটি ডুব দিল। উঠে দেখল একমাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, ধবধবে গায়ের রঙ। এসব দেখে ভাবলো, একবার ডুব দিয়েই এত রূপ খুলল আর একবার ডুব দিলে নিশ্চয়ই আর বেশি সুন্দরী হবে। ভাবতে না ভাবতেই আবার ডুব দিল। যেই না জল থেকে উঠল। একি! কাকে দেখছে? কালো কুৎসিত, টেকো মাথা নিজেকে দেখে ও কাঁদতে কাঁদতে ঋষির কাছে গেল। ঋষি ওকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “দূর হয়ে যাও। অবাধ্য মেয়ে, তুমি আমার কাছ থেকে কোন আশীর্বাদ পাবে না”। রাগে অন্ধ হয়ে সে বাড়ির দিকে ছুটল।
ইতিমধ্যে বনিক বাণিজ্য সেরে বাড়ি ফিরে এক মাথা ভর্তি কালো চুল, এত সুন্দরী বড় বউকে দেখে তিনি তার প্রেমে পরে গেলেন। তারপর তার ঐশ্বর্য ও অন্যান্য জিনিসপত্রের রহস্য জেনে তাকে ভালবেসে ফেললেন। তারপর থেকে তারা দুজনে সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগলেন। আর ছোট বউ যাকে বণিক কোন এক সময়ে ভালবাসতেন সেই বউকে বাড়ির দাসীর কাজ দিলেন।