অনিমেশের ডায়রি
সৌমেন মৌলিক
১লা মার্চ
------
গোবর্ধনবাবুর একটা ব্যক্তিগত লেখালেখির খাতা আজ জোগাড় করা গেছে। গতকাল পুলিশগুলো লাশের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়নি। নৃশংস দুর্ঘটনা বা খুন বা আত্মহত্যা। গলার নলি টা চেরা ছিল, চাপচাপ রক্ত জমে ছিল গলায়। এখনও পুলিশ কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। ভাগ্যক্রমে পুলিশ এর হাতে খাতাটা পড়েনি, যেটা বেশ অস্বাভাবিক ঘটনাও বটে, এবং একইসাথে পুলিশের গাফিলতিও বলা চলে। অনেকটা কৃতিত্ব অবশ্যই রতনকে দিতে হয়। গোবর্ধনবাবুর ঐ অগোছালো ঘর থেকে পুলিশের চোখের আড়ালে খাতাটা সরিয়ে রেখেছিল রতন। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে ওনার যাবতীয় খেয়াল ঐ রতন-ই রাখত। গোবর্ধনবাবু নিঃসন্তান। আত্মীয়স্বজন ও বিশেষ একটা আছে বলে মনে হয়না। বইপত্র, গানবাজনা, আর টুকটাক লেখালেখি নিয়েই ভদ্রলোক থাকতেন, নিজের একটা সমান্তরাল এবং আলাদা পৃথিবী তে। সারাজীবনের সঞ্চয় ভোগ করতেন, অথচ বিলাসিতা সে অর্থে ছিলনা বললেই চলে। সেই সঞ্চয়ও পুরোটা ভোগ করা হলনা আর। বর্তমানে ঐ বড় বনেদী বাড়িটায় রতন একা। সে চেষ্টা চালাচ্ছে যদি কোনোভাবে ওনার কতিপয় আত্মীয়স্বজনের সাথে একটা যোগাযোগ করা যায়। এরম বলাটা যদিও ঠিক না, তবুও সত্যি বলতে, আমি কিরম যেন একটা আলাদা উত্তেজনা অনুভব করছি পুরো ব্যাপারটা ঘিরে। বিশেষ করে রতন ওনার খাতাটা আমায় দেওয়ার পর থেকে আরেকটু বেশী-ই অনুভব করছি। জানিনা কেন।
২রা মার্চ
------
গোবর্ধনবাবুর খাতাটা আজ পড়ছিলাম। খুব অদ্ভূত অনেক কিছু লেখা। না, কোনও সাহিত্য নয়। কিছু ঘটনা পরপর লিখে যাওয়া। লেখার মধ্যে কোনও বিরতি নেই, স্তবক ভাগ নেই, অনুচ্ছেদ নেই। প্রতিটি ঘটনা নিম্নচাপের বৃষ্টির মতই ঘ্যানঘ্যানে। এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় হরকে যাওয়ার মাঝে কিছুটা বিরতি, তাও যেন সেটাও খুব একটা ইচ্ছার সাথে দেওয়া হয়নি। ওনার ঘরের মতই অগোছালো লেখাগুলো। তবে যেটুকু বোঝা গেছে, এই খাতাটাকে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি বলা যেতে পারে। ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনও যোগাযোগ নেই বলেই মনে হয়। মানে যতটা পড়েছি এখনও অবধি, তাতে সেরম কোনও যোগাযোগ আছে বলে মনে হয়নি। ধরেও নেওয়া যেতে পারে সেগুলো সময়ের হিসাবে বর্তমান অভিমুখি। প্রতিটা ঘটনা বা একসাথে দু-তিনটি ঘটনা যেন এক একটা ছোটোগল্প। ‘গল্প’ বলছি কারণ ঘটনাগুলোর চরিত্রেরা সম্ভবত কাল্পনিক। মাঝেমাঝেই কিছু চরিত্র আবার ফিরে আসে কয়েকটা পাতা পর, অন্য কোনও ঘটনাকে ঘিরে পাক খেতে থাকে। রতন কে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আজ বেলায়, এই নামের লোকজন আশেপাশে আছে কিনা। রতন জানিয়েছিল ওর চেনা কেউ নেই এরম আশেপাশে।
৩রা মার্চ
------
আজকে একটি অন্য ধরণের লেখা পড়লাম ওনার খাতা থেকে। গতকাল যতটা অবধি পড়েছিলাম তার পর থেকে আরও অনেক ঘটনা আর সেই ঘটনাকে ঘিরে কিছু পুরানো এবং আরও কিছু নতুন চরিত্রের আবর্তন চোখে পড়ল। খুব বেশী আর বাকি নেই। কিন্তু তার মাঝেই এই গল্পটা বা ঘটনাটা বেশ অন্যরকম। যেন এই প্রথম একটা লেখা যেটা বাকিদের মাঝে নিজের একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণ করছে। আর লেখাটাও কিরম যেন একটা স্যাঁতস্যাঁতে প্রকৃতির। লেখাটার কেন্দ্রে আছেন এক ভদ্রলোক, যাকে আগে কোনও লেখায় পাইনি। ইনি হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে লেখালেখি করে থাকেন। একপ্রকার বলা যায় ডায়রি লেখেন নিয়মিত। গোবর্ধনবাবুর মতই লিখে রাখেন গুচ্ছ গুচ্ছ ঘটনা, ছোটোখাটো, এবং সেরম গুরুগম্ভীর বা গুরুত্বপূর্ণও নয়। চারপাশে যা ঘটে চলে বা ঘটে চলেছে। মফস্বলের পাড়া যেরম ঘটনাবহুল। ঠিক সেরম। পাশের বাড়ির কালো কুকুরটার ঘি-ভাত খেয়ে অকাল মৃত্যু-ও যেমন সেখানে আছে, সেরম-ই আছে ক্লাব সেক্রেটারি শ্যামলদার ছেলের জন্মের ঘটনার উল্লেখ। মজাটা অন্য জায়গায়। তিনি যে লেখাগুলো লিখতেন সেগুলো কোনও না কোনও ভাবে অদূর ভবিষ্যতে ঘটে যেত। ঘটনাগুলোর চরিত্রগুলো সাজানো, ওনার হাতে তৈরী। কিন্তু ঘটনাগুলো সত্যি হয়ে যেত। যেন বাস্তব কিছু ঘটনার, যা ঘটবে, তার স্ক্রিপ্ট তিনি রোজ তৈরী করে রাখতেন নিয়ম করে, রোজ মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আরেক ঘুমের মাঝের সময়ে। আর ওনার সেই পান্ডুলিপি থেকে ঘটনাগুলো যেন ওনার অজান্তেই চুরি হয়ে যেত, আর নায়ক-নায়িকা পাল্টে ঘটনাগুলো মিশে যেত বাস্তবে। এই অদ্ভূত ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। মনে করা হয় উনি খুন হয়েছিলেন, যদিও কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি। ওনার লেখালেখি থেকে শেষ যে লেখাটা উদ্ধার করা হয় সেটা কোনও সুইসাইড নোট নয়। বরঞ্চ এক ব্যক্তির সুইসাইডের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় ওনার শেষ লেখা থেকে।
গোবর্ধনবাবুর খাতা থেকে এই অদ্ভূত গল্পটা পড়ে কিছুটা থম মেরে গেছিলাম আজ বেলায়। লেখাটা পড়ে আমি ওনার খাতার পাতা উল্টে আগের লেখাগুলোর কিছু কিছু আবার পড়ি। ওনার লেখা এই সামান্য চরিত্রটা রোজ মাঝরাতে উঠে কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছে। এই চরিত্রটা যেন কিছু বলতে চায়। আমি রতনকে দুপুরেই লেখাটা পড়ার পর জিজ্ঞেস করলাম যে গোবর্ধনবাবুর লেখা আগের এই ঘটনাগুলো ওদের বাড়ির আশেপাশে বা কিছুটা দূরে ঘটেছে কিনা কখনও, খুব কাছাকাছি সময়ে। রতন ঐ টুকটাক কাজ ছাড়া খুব একটা বাইরের খবর রাখতো না। তবে রতনের একটা শাগরেদ আছে। বিরি খাওয়ার সঙ্গী। সে ব্যাটা বেশ চৌখস। রতন ওকে জিজ্ঞেস করবে বলল। যদি সেরম কিছু জানতে পারে তাহলে কাল সকালে জানাবে বলেছে। ততক্ষণ অপেক্ষা।
৪ঠা মার্চ (দুপুর)
------------
রতন সকালে ফোন করেছিল। কিরম একটা শিরশিরানি লাগছে। তাই দুপুরেই লিখতে বসলাম। মনঃসংযোগ করতে পারছিনা কিছুতেই। খাতার লেখা, বাস্তব ঘটনা সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। গোবর্ধনবাবু কিছু চরিত্রের জন্ম দিচ্ছেন, নাকি কিছু চরিত্র গোবর্ধনবাবুর প্রতি মুহুর্তের জন্ম দিচ্ছে? রতন মোটামুটি যুদ্ধকালীন তৎপড়তায় খোঁজখবর নিয়ে এরম কিছু ঘটনার হদিস দিল যেগুলো গোবর্ধনবাবুর খাতার ঘটনাগুলোর সাথে হুবহু মিলে যায়, আর ঘটনাগুলোও খুব আশেপাশে না হলেও কাছেপিঠের মধ্যেই ঘটেছিল। এবং বলাই বাহুল্য উনি প্রতিক্ষেত্রেই বাস্তব ঘটনাগুলোকে বহু আগেই পাতায় লিখে গিয়েছেন। ঠিক সেরমভাবেই যেরমভাবে ওনার তৈরী সেই অদ্ভূৎ চরিত্রটি করতেন। একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কিরম যেন সব ঘেঁটে যাচ্ছে মাথার ভিতরে। আজ রাতে খাতাটা শেষ করতেই হবে পড়ে। আরও অনেক কিছু হয়তো বলতে চায় খাতাটা।
৪ঠা মার্চ (মাঝরাত)
--------------
আমি জানিনা আমি কি লিখতে চলেছি। আমি জানিনা আমি এতক্ষণ কি পড়লাম। মাথাটা পুরো ধরে আছে। এটা কি কোনও দুঃস্বপ্ন? নাকি সত্যি এগুলো ঘটছে আমার সাথে? আমি যা দেখছি, যা পড়ছি সেগুলো কি সত্যি-ই বাস্তব? গোবর্ধনবাবুর খাতার শেষ লেখাটা এখানে টুকে দেওয়া ছাড়া আমি আর বিশেষ কিছু করার ক্ষমতায় নেই। আমার মাথা টা কাজ করছেনা আর। ...
“মঔত তু এক কভিতা হ্যায় / মুঝসে কভিতা কা ওয়াদা হ্যায় মিলেগি মুঝকো / ডুবতি নব্জো পে যব দর্দ কো নিন্দ আনে লাগে / দর্দ সা চেহরা লিয়ে চান্দ উফক্ তক পঁঔছে / দিন আভি পানি মে হো, রাত কিনারেকে করিব / না আভি আন্ধেরা, না উজালা হো, না আধি রাত না দিন / জিস্ম যব খত্ম হো, ঔর রূহ্ কো যব শাঁস আয়ে / মুঝসে কভিতা কা ওয়াদা হ্যায় মিলেগি মুঝকো... মৃত্যুর আগে পিপড়েদের দেখেছি ডানা মেলে উড়ে উড়ে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়তে লন্ঠনের গায়ে। যেন কেউ তাদের আদেশ দেয়। আর এক চিরন্তন বিশ্বাসের সাথে তারা সেই আদেশ পালন করে চলে। আত্মহননের পথ বেছে নেয় কোনও এক অদৃশ্য খুনির আদেশে। তাহলে একে কি আত্মহত্যা বলা চলে? জানিনা। তবে আমার কানে কানে যেন সেরম-ই এক আদেশ কেউ দিচ্ছে। ঘরের পরিবেশ টা বড্ড শীতল, স্যাঁতস্যাঁতে লাগছে। ঘাড়ের কাছে একটা ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করছি। তবে! এটা কি হাওয়া? নাকি নিঃশ্বাস? কার নিঃশ্বাস? কোনও অদৃশ্য আততায়ী? মুঝসে কভিতা কা ওয়াদা হ্যায় মিলেগি মুঝকো... সে কি এসেছে তবে?”
========================================================================
=================================
জয়বাংলা পত্রিকা, ১০ই মার্চ, নিজস্ব সংবাদদাতা
=================================
গত কয়েকদিন ধরে উত্তর কলকাতায় বেশ কিছু রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে চলেছে। এখনও পর্যন্ত প্রতিটা মৃত্যুকে খুন বলে সন্দেহ হলেও খুনির টিকি অবধির সন্ধান করতে পারেনি কোলকাতা পুলিশ। আত্মহত্যার সন্দেহ ও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা। তবে প্রতিক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সাদৃশ্য খুন-এর পাল্লাকেই ভারী করে। গলার নলি কেটে খুন। গত একমাস ধরে ঘটে চলা এই দুর্ঘটনার কোনও কিনারা এখনও করা যায়নি। শেষ দুটি মৃত্যুর মধ্যে প্রথমে খুন বা আত্মঘাতী হন বউবাজার-এর বিজন ব্যানার্জী। ইনি পেশায় উকিল। ঠিক এক সপ্তাহ আগে ৩রা মার্চ অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে ওনার বাড়িতে ওনার মৃত্যু হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার বিপত্নীক বিজনবাবুর দেখভাল করা চাকর সঞ্জয় বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও কোনও টের পায়নি। সঞ্জয় কে জিজ্ঞাসাবাদ করে সেরম কিছু জানা যায়নি বলে পুলিশসূত্রে খবর। এই দুর্ঘটনায় সঞ্জয় যে সম্ভবত জড়িয়ে নয় সেই ধারণা আরও জোড়ালো হয় যখন পরশু রাতে আবার একটি একই রকম মৃত্যুর ঘটনার খোঁজ মেলে বেলেঘাটায়। এবার শিকার ডঃ অনিমেশ বেরা। উনি বেলেঘাটায় একটি ভাড়া বাড়িতে একা থাকতেন। গোটা একটি দিন কোনও সাড়াশব্দ না পাওয়ায় প্রতিবেশীদের সন্দেহ জাগে। ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কিতেও যখন কোনও লাভ হয়না তখন প্রতিবেশীদের হস্তক্ষেপে গতকাল বিকেলে পুলিশ-এ খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এলে দরজা ভেঙে ওনার ঘরে ঢোকা হয়। সেই মুহুর্তে ওনার স্টাডি রুম-এ ওনাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। শক্ত পাথর হয়ে যাওয়া লাশ। গলার নলিটা কাটা। চাপচাপ রক্ত জমে থাকতে দেখা যায় গলায়।