মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩
বিষ্ণু হইতে সৃষ্টি এবং তাঁর নাভিপদ্মে ব্ৰহ্মার জন্ম
প্রাককথন
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
বিষ্ণু হইতে সৃষ্টি এবং তাঁর নাভিপদ্মে ব্ৰহ্মার জন্ম
যুধিষ্ঠির গভীর আগ্রহে সৃষ্টিতত্ত্বের নিগূঢ় রহস্য জানবার উদ্দেশ্যে ভীষ্মকে বললেন, “পিতামহ! যিনি সকলের স্রষ্টা, যাঁর স্রষ্টা কেউই নয়, যিনি পুণ্ডরীকাক্ষ, অচ্যুত, বিষ্ণু, হৃষীকেশ, গোবিন্দ ও কেশব প্রভৃতি নামে বিখ্যাত, আমি সেই সৰ্ব্বজীবের স্রষ্টা নারায়ণের বৃত্তান্ত শুনতে ইচ্ছুক, আপনি বিশেষভাবে আমাকে সেই বৃত্তান্ত বর্ণনা করুন।”
ভীষ্ম বললেন, মহারাজ! আমি জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, দেবর্ষি নারদ ও বেদব্যাসের নিকট ঐ বৃত্তান্ত শুনেছি। ভগবান অসিত, দেবল, মহাতপাঃ বাল্মীকি ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয় নারায়ণের বিষয়ে অতি সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। আমি অনেক মহাত্মার মুখে শুনেছি যে, ভগবান নারায়ণ পুরুষপ্রধান ঈশ্বর ও সর্ব্বব্যাপী। যাই হোক, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং পুরাণবেত্তা সাধুগণ নারায়ণের সম্পর্কে যে সকল গুণ কীৰ্ত্তন কোরে গেছেন, আমি সে সমস্ত তোমাকে বলছি, অবধান করো।
“ভগবান পুরুষোত্তম নারায়ণ আকাশ, বায়ু, পৃথিবী, তেজ ও জল এই পাঁচ মহাভুতের সৃষ্টি করবার পরে স্বয়ং জলের উপরে শয়ন করলেন। তারপর তিনি প্রথমে মনের মধ্যে অহঙ্কারের সৃষ্টি করলেন। সেই অহঙ্কারবলে পরবর্তীকালে জীবগণের সংসারকার্য্য নির্বাহ হোচ্ছে। অহঙ্কার সৃষ্টির পর সলিলশায়ী ভগবান নারায়ণের নাভিদেশে সূর্যের মতো উজ্জ্বল এক পদ্মফুল ফুটে উঠলো। লোকপিতামহ ব্রহ্মা নারায়ণের সেই নাভিপদ্ম থেকে আবির্ভুত হোলেন। পদ্মযোনি ব্রহ্মা আবির্ভুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উজ্জ্বলতায় চতুর্দিকে আলোকিত হয়ে উঠলো। ভগবান ব্রহ্মার উৎপত্তির পর তমোগুণ সম্পন্ন মধু নামে এক অসুর জন্মগহণ করে তাঁর উপর অত্যাচার করতে লাগলো।
তখন পুরুষোত্তম নারায়ণ লোকপিতামহ ব্রহ্মাকে রক্ষা করার জন্য ঐ বিকট অসুরকে বিনাশ করলেন। মহাত্মা নারায়ণ তৎকালে সেই দুরাত্মা অসুরকে বিনাশ করেছিলেন বলে দেব, দানব ও মানব প্রভৃতি সকলে তাঁকে মধুসূদন নামে আহ্বান করেন।
মধু দৈত্য নিহত হওয়ার পরে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য পুলহ ও ক্রতু নামে ব্রহ্মার মানস পুত্রগণের জন্ম হয়েছিলো তার মধ্যে থেকে কশ্যপ আবির্ভুত হন। বেদবিদ্যা বিশারদ মরীচি মুনির জন্মগ্রহণের পুৰ্ব্বে ব্রহ্মার আঙ্গুল হইতে আর একটি পুত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। তাঁর নাম দক্ষ প্রজাপতি। দক্ষের প্রথমে তেরোটি কন্যার জন্ম হয়। ঐ কন্যাগণের মধ্যে দিতি সবার বড়ো। ধর্মজ্ঞ মহাযশস্বী মরীচির পুত্র কশ্যপ ঐ কন্যাদেরকে বিবাহ করেছিলেন।
তারপর প্রজাপতি দক্ষ আর দশটি কন্যার জন্মদান কোরে করিয়া ধর্মের সঙ্গে বিবাহ দেন। ধর্ম্মের ঔরসে তাঁদের গর্ভে বসু, রুদ্র, বিশ্বদেব, সাধ্য ও বায়ু প্রভৃতি পুত্ৰগণের জন্ম হয়। ঐ দশ কন্যার জন্মের পর দক্ষের আরও ২৭টি কন্যা জন্মিয়াছিল। ভগবান চন্দ্র তাঁদেরকে বিবাহ করেন। কশ্যপের পত্নীগণের মধ্যে অদিতির গর্ভে মহাবল পরাক্রান্ত দেবশ্রেষ্ঠ আদিত্যগণ উৎপন্ন হইলেন। ঐ আদিত্যগণের মধ্যে বামনরূপী বিষ্ণু অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই বামনদেবের বিক্রমে দেবগণের শ্রীবৃদ্ধি এবং দানব ও অসুরগণের অবনতি হোতে থাকলো। দনু বিপ্রচিত্তি প্রভৃতি দানবকে ও দিতি মহাবল পরাক্রান্ত অসুরগণকে এবং কশ্যপের অন্যান্য পত্নীগণ গন্ধৰ্ব্ব, তুরঙ্গ, পক্ষী, গো, কিম্পুরুষ, মৎস্য ও উদ্ভিজ্জ সমুদয়ের জন্মদান করেছিলেন।
অতঃপর ভগবান মধুসুদন দিন, রাত্রি, কাল, ঋতু, মেঘ ও পৃথিবীর যাবতীয় স্থাবর এবং জঙ্গমের সৃষ্টি করবার পর মুখ হইতে একশত ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে একশত ক্ষত্রিয়, ঊরুদেশ হইতে একশত বৈশ্য এবং পাদদেশ হইতে একশত শূদ্রের জন্ম দিলেন। হে মহারাজ! ভগবান নারায়ণ এইরূপে চার বর্ণের সৃষ্টি কোরে অবশেষে বেদবিধাতা ব্রহ্মাকে সৰ্ব্বভূতের অধ্যক্ষ, ভগবান বিরূপাক্ষকে ভূত ও মাতৃগণের অধ্যক্ষ, যমরাজকে পাপাত্মাদিগের নিয়ন্তা, কুবেরকে ধনরক্ষক, জলেশ্বর বরুণদেবকে জল ও জলজন্তুগণের অধিপতি এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদয় দেবগণের অধীশ্বর করলেন। ঐ সময় যার যত দিন জীবিত থাকবার ইচ্ছা হোতো, সে তত দিন জীবিত থাকতে সমর্থ হোতো। কাউকেই মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত থাকতে হোতো না। স্ত্রীসংসর্গের আবশ্যকতা ছিল না; ইচ্ছা করলেই লোকে সন্তান উৎপাদন করতে পারতো। ঐ সময়ের নাম সত্যযুগ। সত্যযুগের পর ত্রেতাযুগেও স্ত্রীসংসর্গের প্রথা প্রচলিত ছিল না, সেই সময়ে লোকে কামিনীগণকে স্পর্শ কোরে তাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে সমর্থ হোতো। দ্বাপরযুগ থেকেই পুরুষ ও রমণীর সহবাস প্রথা চালু হয়েছে।
হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমার নিকট সকলের ঈশ্বর জগৎপতি নারায়ণের বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম। এবার উচ্ছৃঙ্খল পাপাত্মাদের বৃত্তান্ত বর্ণনা করছি, শ্রবণ কর। দক্ষিণাঞ্চলে নরবর অন্ত্রক, গুহ, পুলিন্দ, শবর, চুচুক ও মদ্রক এবং উত্তরাঞ্চলে যৌন, কম্বোজ, গান্ধার, কিরাত ও বরগণ নিয়ত পাপানুষ্ঠান কোরে পৃথিবীতে বিচরণ করে। তাদের ব্যবহার চণ্ডাল, কাক ও শকুনের মতো নিতান্ত কদর্য্য। সত্যযুগে ওদের উপস্থিতি ছিলো না, ত্রেতাযুগ থেকে ক্রমে ক্রমে ওদের সংখ্যাবৃদ্ধি হচ্ছিল। এখন ওদের সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য পৃথিবী একান্ত নিপীড়িত হওয়ায় ভগবান নারায়ণের ইচ্ছানুসারে ওরা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পরস্পর পরস্পরকে বিনাশ করছে।
হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে মহাত্মা বাসুদেব থেকেই সবকিছুর উৎপত্তি হয়েছে। সর্বদর্শী দেবর্ষি নারদও বাসুদেবকে সকলের ঈশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন এবং তাঁর নিত্যত্ব স্বীকার কোরে থাকেন। ফলতঃ সত্যপরাক্রম মহাত্মা শ্রীকৃষ্ণ সামান্য মনুষ্য নহেন, তাঁর মহিমা বর্ণনাতীত।”
______________
(ক্রমশ)