The start point of finish in Bengali Short Stories by Brishti Roy books and stories PDF | অন্তে মিলায়ে যায়(দুটি গল্প)

Featured Books
Categories
Share

অন্তে মিলায়ে যায়(দুটি গল্প)

 "১৭৪০ এর দশক, মুর্শিদাবাদের মসনদে তখন আলীবর্দী খাঁ। হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা অঞ্চল হলেও,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আড়ালে ঢেকে যায় সব ।সুখে দুঃখে কেটে যায় দিন। এক রাতের গল্প, নগরবাসী গভীর ঘুমে মগ্ন, হঠাৎ ই শোনা যায় ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। কিছু বোঝার আগেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে ঘর বাড়ি, শুরু হয়ে যায় লুটতরাজ,মেয়ে বউদের সাথে অশ্লীল ব্যবহার, নরহত্যা। বাংলায় বর্গী আক্রমণের সেই শুরু। এরপরে নবাবের যুদ্ধ বর্গীদের সাথে, ভাস্কর পন্ডিতের হত্যা করেও এই আক্রমণ না থামলে শেষে উড়িষ্যা দিয়ে দেওয়া হয় বর্গীদের হাতে।বাঙালির সে ছিল এক ঘুমহীন যুগ, একদিকে খাজনার দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে আত্মরক্ষার ভয়, নিদ্রাহীন রাত গুলো এভাবেই কাটতো তাদের।"- এতদূর বলে থামলেন বর্তমানে শয্যাশায়ী বছর আশির স্বপনবাবু,কলেজের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বারো বছরের নাতনি আকাঙ্খা কে শোনাচ্ছিলেন বাংলায় বর্গী আক্রমণের কাহিনী। লোডশেডিং হয়ে আছে অনেকক্ষণ থেকেই, রাতেও ঘুম আসবে না আর এত গরমে, দূর থেকে অমল দাঁড়িয়ে শুনছিলো দাদু নাতনির এই গল্প, আপন মনেই হাসলো ও। প্রায় দুশো বছর আগের এক নিদ্রাহীন যুগের কাহিনী শুনছিলো ও, পরিস্থিতি এখনো তাই, শুধু সময় টুকু বদলেছে, রাতের পর রাত তাদের চোখ খুলেই কেটে যায়, পরের দিন সংসার চলবে কিভাবে এই ভেবে। লক ডাউন এর পর চাকরি ছাঁটাই এর কোপ থেকে রেহাই পায়নি অমল ও, অর্থের অভাবে এখনো সেই দুশ্চিন্তার স্বপ্ন। .....খাটে একা শুয়ে চিন্তা করে যান স্বপনবাবু। জানেন বেশিদিন আর আয়ু নেই তাঁর।মৃত্যতে আর এমন নিদ্রাহীন রাত্রি কাটাতে হবে না তাঁকে, সত্যিই কি তাই?জীবন নগরীর এই মায়া চক্রে ঘুমের স্থান নেই, মৃত্যুর পরে আবার তাই জীবন জাগরণের শুরু। চিরন্তনী, চরৈবেতি।।

.............


সোমনাথ মন্দিরের দক্ষিণপ্রান্তে ফিকে হয়ে আসা গোধূলির শেষ রংটুকু বড্ড মোলায়েম আজ। সমগ্র মন্দির চত্বর সুবাসিত ফুলের গন্ধে। নাটমঞ্চে দেবদাসীদের নৃত্যস্তুতির আড়ম্বর, আর কিছু সময়ের পরেই অভিজাত ধনী গোষ্ঠী সেই রঙ্গরস উপভোগ করতে উপস্হিত হবে। মন্দিরের পশ্চাতের প্রায়ান্ধকার গৃহ থেকে চুপিসারে বেরিয়ে বাহিরে উঁকি মারলো বেতসী, কৈশোর তার উত্তীর্ণ হয়নি, তবে দেহসৌষ্ঠবে এক মায়াময় লালিত্য, ঋতুমতী হওয়ার পর থেকেই তার স্থান এই মন্দিরে। ও জানে মন্দিরের অপর প্রান্তে লোকচক্ষুর আড়ালে চলছে আরেক প্রস্তুতি,যেখানে দেবদাসীরা সম্ভোগের উপকরণমাত্র। এই অসহ্য জীবনের বেড়াজাল হতে মুক্তি পাওয়ার আশা দেখে বেতসী, যখন প্রথম দেখেছিল গভীর রাতে অনঙ্গকে নদীর ধারে বাঁশি বাজাতে, কথা দিয়েছিল বেতসীকে মুক্ত করার। আজ সেই দিন, সন্ধ্যায় সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে প্রাণপণে ছুটে পৌঁছলো নদীর তটে। জীবনের প্রথম খেয়ালি মুক্তি, কৈশোর মনের প্রথম অনুরাগের শিহরণ,বিভীষিকাময় 'ধর্মীয় গণিকবৃত্তির'থেকে রেহাই, ঘটনার ঘনঘটায় বসে পড়লো বেতসী। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যে আর শেষ হয়না, ভীরু উল্লাস ক্রমেই পরিণত হয় আতঙ্কে, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা গলা টিপে ধরে,অনঙ্গ আসে না। চমকে ওঠে দূর থেকে আসা এক পরিচিত নারী কণ্ঠে। সর্বনাশ!তারই খোঁজ পড়েছে। উঠে দাঁড়ায় বেতসী, পদ্মপাতার মতো দুটি চোখে যেন ধীরে ধীরে শিশির কণা জমে,করুণ হেসে ঝাঁপ দেয় কাবেরীর জলে, মুহূর্তে মিলিয়ে যায় সব। ইতিহাস মনে রাখেনি ষষ্ঠ শতকের এক দেবদাসীর এমন আত্মোৎসর্গের কথা। কাবেরীর কালস্রোতে মিশে গেছে সেই নশ্বর দেহ। কেবল এখনো নিস্তব্ধরাতে কান পাতলে শোনা যায় এক কিশোরীর হাহাকার, যার অপরাধ ছিল তথাকথিত দেবতার তৃপ্ত বন্দিনী হওয়ার থেকে এক সাধারণ অতৃপ্ত মানবনন্দিনী হওয়ার বাসনা।।

অতীত থেকে বর্তমান , হয়তো ভবিষ্যৎ, মানবজীবনে আশা নিরাশার দোলা লেগেই থাকে, কেউ সেই দোলায় আজীবন দোল দিয়েই যায়, কেউ সেই দোটানা সহ্য না করতে পেরে চরম সত্য কে কাছে টেনে নেয়। কেউ তৃপ্ত হয়েও অতৃপ্ত হতে চায়, কেউ বিশ্বাসী হয়েও অবিশ্বাসী হতে চায়। এ সংসারের চাওয়া পাওয়ার হিসেব স্বয়ং দেবতাও বুঝি রাখতে পারেন না।।