তালা খুলতেই একটা আঁশটে গন্ধ এসে ঝাপটা মারলো সুদীপার নাকে।
বৃষ্টির দিনে এই পুরোনো বাড়িতে এরকম গন্ধ ওঠা বিচিত্র কিছু নয়, সুদীপা নিজে অভ্যস্তও এই গন্ধের সাথে; কিন্তু তবুও আজ গাটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো।
কোনোমতে নিজের কাকভেজা শরীরটাকে ঠেলে নিয়ে গেল স্নানঘরে। শাওয়ার চালিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নিচে, শরীরটা কাঁপছে থরথর করে। শাওয়ারের জল একনাগাড়ে পড়ছে চোখেমুখে, পাহাড়ি এলাকা, এখানে জলের ব্যবহার করতে হয় খুব পরিমিত কিন্তু সুদীপার আজ ভ্রূক্ষেপ নেই সেসবে।
আচ্ছা পুলিশ কি সত্যিই দীপ্তকে খুঁজবে? ওরা তো সব শোনা মাত্রই বলে দিলো যে সে কোনোভাবে খাদে গড়িয়ে পড়ছে!
বাড়িতে কি এখনই সব জানাবে সুদীপা নাকি অপেক্ষা করবে সকালের! ভেবে পাচ্ছে না কোনো।
কারেন্ট নেই, ভেজা শরীরেই মোমবাতির সন্ধানে এদিক ওদিক হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ সুদীপা খেয়াল করলো বাইরের দরজাটা হাট করে খোলা। চমকে উঠলো সে, ঢোকার পর দরজাটা কি তবে লাগায়নি! মনে পড়ছেনা কিছুতেই। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে যেতেই হোঁচট খেলো একটা, এটা কে বসে আছে ঘরে! যদিও অন্ধকার তবুও অবয়বটা স্পষ্ট। আতঙ্কগ্রস্ত গলায় সুদীপা চেঁচিয়ে উঠলো, “কে…? কে ওখানে? কৌশিক?”
“কৌশিক বাবুর প্রত্যাশাতে ছিলে বুঝি?”
“ক্ক...কে?”
“চিনতে তো ঠিকই পেরেছো সু, আমি, তোমার দীপ্ত।”
“দী … দীপ্ত?” অজানা আগন্তুকের আতঙ্কে যতোটা না ভয় পেয়েছিল সুদীপা এবার তার থেকেও অনেকগুণ বেশি ভয় পেলো পরিচিত মানুষটার কণ্ঠস্বরে।
“আমাকে ওখানে রেখে কেন চলে এসেছিলে সু? তুমি জানোনা বৃষ্টিকে আমি কতটা ভয় পাই!”
সুদীপা জানে দীপ্ত কতটা ভয় পায় বৃষ্টিকে, আজ থেকে বছর সাতেক আগে এক ভয়ংকর বৃষ্টির দিনেই তো গাছের ডাল পড়ে লোকটা সারা জীবনের মত পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। বছর সাতেক আগে সুদিপা আর দীপ্তর ভালোবাসার সম্পর্ক টা ভালোই চলছিল। কিন্তু হটাৎ একদিন সুদিপা আর দীপ্ত লঙ ড্রাইভ এ এক পাহাড়ি জায়গায় চলে আসে, সেখানেই ঘটে যায় দীপ্তর জীবনের সব থেকে বড়ো দুর্ঘটনা। একদিন প্রচন্ড ঝড় বাদলের দিনে তারা দীপ্ত আর সুদিপা এক জায়গা থেকে হোটেলের পথে ফিরছিলো সেই সময় তাঁদের গাড়ি হটাৎ খারাপ হয়ে যায়। তখন তারা কোনো উপায় না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা পথে রওনা দেয় তখন হটাৎ করে একটা জোরে বজ্রপাত হওয়ার ফলে দীপ্তর গায়ের উপরে একটা আস্ত গাছ ভেঙে পড়ে যায় এবং সেই গাছের নিচে দীপ্ত চাপা পড়ে যায়। তারপর যখন সুদিপা দীপ্তকে আরো কিছু মানুষের সাহায্য নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন বড়ো একটা অপারেশন এর পর ডাক্তার জানায় যে দীপ্ত আর কখনো নিজের পায়ে চলা ফেরা করতে পারবে না। আর কখনো সে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এটা সোনার পর দীপ্ত পুরোপুরি ভেঙে পড়ে মানসিক আর শারীরিক দিক দিয়ে,
তাই তারা ঠিক করে যে সেখান থেকে পালিয়ে আসবে। তারপর কেটে যায় আরো ২ বছর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো কিন্তু একদিন দীপ্ত আর সুদিপা আবার সেই পুরোনো হোটেলে ফিরে গেছিলো তাঁদের কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য। কিন্তু তাঁদের ভাগ্যের এমনি পরিহাস যে তাঁদের রাস্তায় যাওয়ার সময় একটা রোড এক্সিডেন্ট হয় খুব বড়ো রকমের সেখানে সুদিপা কোনো রকমে বেঁচে গেলেও দীপ্ত গাড়ি সমেত পাহাড়ের খাঁদে পড়ে যায়।
সুদিপা অনেক খোজা খুঁজির পরেও আর দীপ্ত কে খুঁজে পায় না। তারপর সুদিপা যখন বাড়ি ফিরলো এরপরের ঘটনা তো আপনারা জানেন।
সুদিপা এসব ভাবছিলো আর তখনি দীপ্ত হুইল চেয়ারটা ঠেলে এগিয়ে আসছে ওর দিকে, গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে সুদীপার। দীপ্ত এসে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে; ওর ভেজা শরীরটা শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠলো, “তু… তুমি ফিরলে কি করে দীপ্ত?”
“ওরা নিয়ে এলো আমাকে…” কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনালো দীপ্তর গলাটা।
“কারা!”
“আশেপাশে ওদের দেখতে পাচ্ছনা?”
“নাহহ… কাদের কথা বলছো তুমি?”
“ওই যে আঁধারের বাসিন্দা যারা, যে আঁধারে আজ তুমি আমাকে ফেলে এসেছিলে।”
“দীপ্ত…!” চিৎকার করে উঠলো সুদীপা।
“তোমায় ছাড়া যে আমার এক মুহূর্তও চলে না সু, আমাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় পালাবে ভেবেছিলে?”
“নাহহ… নাহহ…” দীপ্তর বাহু বেষ্টনী ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করলো সুদীপা, কিন্তু পারলো না এক চুলও নড়তে। ও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে দুটো হাত যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসে জড়িয়ে ধরেছে ওর পা, আশেপাশে ছায়া ছায়া কারা যেন ভাসছে ঘর জুড়ে, সুদীপার সারা শরীর জুড়েও অনুভূত হচ্ছে অশরীরী আনাগোনা… পৈশাচিক এক খেলায় মেতেছে ওরা, ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দীপ্তও।
নাআআআআ…. আর্তনাদ করে উঠলো সুদীপা;
বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মিলিয়ে গেলো সেই আর্তনাদ, পালাবার পথ নেই আর….........
সমাপ্ত ....