সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্বে জোব চার্ণক নামে একজন ইংরেজ তিনটি স্নিগ্ধ গ্রাম গোবিন্দপুর, সুতানুটি আর কলকাতার তীরে পৌঁছোলেন এবং নবাবের সৈন্যদল কর্তৃক লুণ্ঠিত তাঁর কর্মস্থল হুগলিতে আর ফিরে গেলেন না। তিনি চাইলেন এই গ্রামগুলিতেই শুরু হওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করবেন। এইভাবে শুরু হল এক ইতিহাস।
প্রথমেই কাঁচা বাড়িগুলি ভেঙে পাকা বাড়ি উঠতে দেখা গেল, ব্রিটিশের ইজারা নেওয়া গ্রামগুলি ধীরে ধীরে গড়ে তুলল এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। দরবারি উত্থান-পতন আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকে কলকাতা বিকশিত হতে শুরু করল দ্রুত। কিন্তু সেই সময়কার দলিল বলছে, এটা আদপেই কোনো প্রামাণ্য শহর ছিল না। না ছিল রাস্তায় আলো, না ছিল পাকা রাস্তা, না ছিল পরিশ্রুত জল বা পাকা নর্দমা। অকালমৃত্যুর হার ছিল অত্যধিক বেশি। তবু এ শহর অনেককে কাছে টানল।
গোড়ার দিকে কোনো নাগরিক বা পৌর প্রতিষ্ঠান কলকাতায় ছিল না। শুধু বিচার বিভাগীয় কাজকর্মের জন্যে একটা ‘মেয়রস্ কোর্ট’ চালু হয়েছিল ১৭২৬-এ রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে। এই দপ্তরই সমস্ত পৌর কাজকর্ম দেখাশুনো করত, যাতে এই শহরের প্রতি নাগরিকেরা আকৃষ্ট হয়। ১২ আগস্ট ১৭৬৫-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেল বাংলার দেওয়ানি সনদ। যাতে বিচার ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বর্তালো কোম্পানির ওপর।এই দায়িত্ব থেকেই মানবিক দায় বর্তালো নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের। যখন ১৭৭৩-এ কলকাতা হয়ে উঠল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী, পৌর প্রতিষ্ঠানের জন্য দাবি হল জোরদার।
ঊনবিংশ শতকের প্রথম পর্বে ব্রিটিশ গর্ভনর জেনারেলরা শহরের উন্নতিকল্পে তহবিল গঠনের জন্য লটারির আয়োজন করেন। এই সমস্ত লটারি থেকে প্রাপ্ত তহবিলে শহরে নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরনো রাস্তার উন্নয়ন, দিঘি খনন প্রভৃতি করা হয় এবং একখানি টাউন হল নির্মাণ করা হয়।
ওই শতকের মধ্যপর্বে এসে একটি পৌর প্রতিষ্ঠান গঠনের চেষ্টা করা হয়। বোঝা গিয়েছিল যে, শহর বিস্তৃত হয়েছে এবং এর পরিচালনার জন্য সঠিক এবং নির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন। তাছাড়া ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই ‘দ্বিতীয় শহর’টিতে উন্নততর পরিকাঠামো আর ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছিল, যাতে শহর তার নিজস্ব সমস্যা মেটাতে পারে।
এজন্য ১৮৪৭-এ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে বিচারবিভাগীয় প্রশাসনের বদলে সাতজন বেতনভোগী সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এদের নির্বাচিত করেন করপ্রদানকারী বাসিন্দারা। এই বোর্ডকে শহরের উন্নতি এবং রাস্তা বা নর্দমার সংরক্ষণের জন্য সম্পত্তি ক্রয় এবং অধিকারে রাখার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৮৫২-য় এই বোর্ডের বদলে নতুন চার সদস্যের বোর্ড তৈরি করা হয় যার দু’জন সরকার দ্বারা নিযুক্ত আর দু’জন নির্বাচিত। এই সময়ে বসবাস, আলো, ঘোড়া বা গাড়ি ব্যবহারের জন্য কর ধার্য করা হয়।
১৮৬৩-তে ফের নতুন বোর্ড তৈরি হয় যারা নিজস্ব উপ-পৌরপ্রধান নির্বাচন করেন। এছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্য আধিকারিক, স্থপতি, আমিন, কর-সংগ্রাহক বা নিয়ামক নিয়োগ করা হয়। এই সময়েই পয়ঃপ্রণালি এবং জলসরবরাহ সেবা উৎকর্ষতা লাভ করে। ১৮৬৬-তে কসাইখানা এবং ১৮৭৪-তে নিউ মার্কেট প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে বড় রাস্তাগুলির ধারে ধারে ফুটপাথ তৈরি হয়। এই সময়ে বসবাসের জন্য কর দশ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৮৭৬-এ ৭২ জন কমিশনার (পৌর প্রতিনিধি) সমন্বিত নতুন পৌর প্রতিষ্ঠান (কর্পোরেশন) স্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৪৮ জন নির্বাচিত এবং ২৪ জন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। এই সময়েই হাওড়া ও শিয়ালদায় দুটি প্রান্তিক রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে সংযোগকারী হ্যারিসন রোডটি নির্মিত হয়। নানান পরিবর্তন - পরিবর্ধন চলতে থাকে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম স্থানীয় স্ব-শাসন মন্ত্রী করে ১৯২৩-এ এ সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
এই আইনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সংযোজিত করে স্ব-শাসন-ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং সরকারি হস্তক্ষেপ লঘু করা হয়। মানিকতলা, কাশীপুর, চিৎপুর, গার্ডেনরিচ তথা নতুন বন্দর এলাকাকে সংযুক্ত করে বৃহত্তর কলকাতার রূপদান করা হয়। এই আইনের বলে এই প্রথম মহিলাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় শাসনপ্রণালিতে। তার প্রতি সম্মান জানাতে কলকাতা পৌরপ্রতিষ্ঠান তার প্রধান দপ্তরের লাগোয়া রাস্তার নামকরণ করে রাষ্ট্রগুরুর নামে।
১৮৯৬-এ কর্পোরেশনের নিজস্ব মোহরচিহ্ন (এমব্লেম) তৈরি হয়। এতে দেখানো হয় একজোড়া হাড়গিলে পাখি তাদের পা দিয়ে একটি মুকুট বহন করছে। এরপরে নতুন করে মোহরচিহ্ন তৈরি হয় ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ যাতে শহরের নবতম আশা-আকাঙ্ক্ষা চিহ্নিত হয়।
কলকাতা পৌর প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৮০ লাগু হয় ১৯৮৪-র জানুয়ারিতে। এর মাধ্যমে সাউথ সুবার্বান, গার্ডেনরিচ এবং যাদবপুরকে আওতার মধ্যে আনা হয়। এর ওয়ার্ড সংখ্যা ১০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪১-এ। বস্তি সংক্রান্ত আইনও পরিমার্জন করা হয়।
বাড়ি, জমি, বকেয়া-আদায় নিয়ে এবং করধার্যকরণ এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত সুবিধার্থে ব্যবস্থাবিধির ব্যাপক রদবদল হয় ১৯৮৪তে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখেযোগ্য হল, সরকারি ক্যবিনেটের মতন করে মেয়র-ইন-কাউন্সিল গঠন। ভারতে এ ধরনের পৌর প্রশাসক নিয়োগ ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা।
এই নতুন আইনের লক্ষ্য ছিল পৌর পরিষেবাকে আরও দক্ষ এবং উপযোগী করে তোলা। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে পৌর প্রশাসনকে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করা হয় :
১) কর্পোরেশন,
২) মেয়র-ইন-কাউন্সিল, এবং
৩) মেয়র।
কর্পোরেশনের সদস্য সংখ্যা প্রত্যেকটি ওয়ার্ড থেকে একজন করে নির্বাচিত কাউন্সিলার নিয়ে মোট ১৪১ জন।
মেয়র, ডেপুটি মেয়র এবং আরো দশজন নির্বাচিত সদস্যকে নিয়ে গঠিত মেয়র-ইন-কাউন্সিল কর্পোরেশনের একটি সংস্থা হিসেবে তার কর্তব্য পালন করে।
মেয়র এবং চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সদস্যদের দ্বারা এবং তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য কর্তব্যে বহাল হন।
ওয়ার্ডগুলির কিছু কিছু একত্রিত করে একেকটি বরো গঠিত হয়। প্রত্যেক বরো-তে একটি কমিটি থাকে যা ওই ওয়ার্ডগুলিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। তাঁরা নিজেদের মধ্যে একজনকে চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করেন। এই বরো-কমিটি মেয়র-ইন-কাউন্সিলের সাধারণ তত্ত্বাবধানে থেকে জল-সরবরাহ, নর্দমা, আবর্জনা সংগ্রহ এবং দূরীকরণ, প্রতিষেধক ব্যবস্থা, বস্তি উন্নয়ন, বিজলি, কিছু কিছু রাস্তাঘাট সারাই, পার্ক বা গলি ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি করে।
১৯৮০-র সংশোধিত আইন আধুনিক পৌর প্রতিষ্ঠানটির সাংগঠনিক রূপদান করে মিউনিসিপাল কমিশনারকে প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসার হিসেবে রেখে, যার তত্ত্বাবধানে থাকেন মেয়র, মুখ্য কার্যনির্বাহী হিসেবে। কমিশনারকে সহযোগিতা করেন কয়েকজন সিনিয়র সিভিল অফিসার, মুখ্য বাস্তুকার, মিউনিসিপাল ফাইনান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টসের প্রধান, মিউনিসিপাল চিফ অডিটর এবং মিউনিসিপাল সেক্রেটারি (সচিব)।
১৯৯২ সালে ৭৪-তম সাংগঠনিক বিধি পরিমার্জনের দ্বারা সমাজের সকল স্তরের মানুষের সঠিক এবং যথাযোগ্য অংশগ্রহণ নির্দিষ্ট করা হয়। এই পরিবর্তনের দ্বারা তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ধার্য করা হয়। এই পরিমার্জন মোতাবেক রাজ্য আইনসভা কর্পোরেশনকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য পরিকল্পনা করার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা দেয়। এই দায়িত্বের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পঠন-পাঠন এবং নান্দনিক বিষয়সহ জীবনের নানা বিষয়ের উন্নতিসাধন ও উৎকর্ষতাবৃদ্ধি অন্যতম।
২০০১ সালের নতুন নামকরণের পর ক্যালকাটা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (CMC), কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (KMC)-তে রূপান্তরিত হয়। যে বলটি অষ্টাদশ শতকের কোনো এক সময়ে গড়ানো হয়েছিল, তা আজও সঞ্চরণশীল এবং ক্রমাগত পরিবর্তন-পরিমার্জনের পথ বেয়ে এর নাগরিকদের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে।