Chokher Bali - 15 in Bengali Fiction Stories by Rabindranath Tagore books and stories PDF | চোখের বালি - 15

Featured Books
  • My Passionate Hubby - 5

    ॐ गं गणपतये सर्व कार्य सिद्धि कुरु कुरु स्वाहा॥अब आगे –लेकिन...

  • इंटरनेट वाला लव - 91

    हा हा अब जाओ और थोड़ा अच्छे से वक्त बिता लो क्यू की फिर तो त...

  • अपराध ही अपराध - भाग 6

    अध्याय 6   “ ब्रदर फिर भी 3 लाख रुपए ‘टू मच...

  • आखेट महल - 7

    छ:शंभूसिंह के साथ गौरांबर उस दिन उसके गाँव में क्या आया, उसक...

  • Nafrat e Ishq - Part 7

    तीन दिन बीत चुके थे, लेकिन मनोज और आदित्य की चोटों की कसक अब...

Categories
Share

চোখের বালি - 15

15

১৫

বাহির হইতে নাড়া পাইলে ছাই-চাপা আগুন আবার জ্বলিয়া উঠে। নবদম্পতির প্রেমের উৎসাহ যেটুকু ম্লান হইতেছিল, তৃতীয়ক্ষপের ঘা খাইয়া সেটুকু আবার জাগিয়া উঠিল।

আশার হাস্যালাপ করিবার শক্তি ছিল না, কিন্তু বিনোদিনী তাহা অজস্র জোগাইতে পারিত; এইজন্য বিনোদিনীর অন্তরালে আশা ভারি একটা আশ্রয় পাইল। মহেন্দ্রকে সর্বদাই আমোদের উত্তেজনায় রাখিতে তাহাকে আর অসাধ্যসাধন করিতে হইত না।

বিবাহের অল্পকালের মধ্যেই মহেন্দ্র এবং আশা পরস্পরের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করিবার উপক্রম করিয়াছিল-- প্রেমের সংগীত একেবারেই তারস্বরের নিখাদ হইতেই শুরু হইয়াছিল-- সুদ ভাঙিয়া না খাইয়া তাহারা একেবারে মূলধন উজাড় করিবারচেষ্টায় ছিল। এই খেপামির বন্যাকে তাহারা প্রাত্যহিক সংসারের সহজ স্রোতে কেমন করিয়া পরিণত করিবে। নেশার পরেই মাঝখানে যে অবসাদ আসে, সেটা দূর করিতে মানুষ আবার যে-নেশা চায় সে-নেশা আশা কোথা হইতে জোগাইবে। এমন সময় বিনোদিনী নবীন রঙিন পাত্র ভরিয়া আশার হাতে আনিয়া দিল। আশা স্বামীকে প্রফুল্ল দেখিয়া আরাম পাইল।

এখন আর তাহার নিজের চেষ্টা রহিল না। মহেন্দ্র-বিনোদিনী যখন উপহাস-পরিহাস করিত, তখন সে কেবল প্রাণ খুলিয়া হাসিতে যোগ দিত। তাসখেলায় মহেন্দ্র যখন আশাকে অন্যায় ফাঁকি দিত তখন সে বিনোদিনীকে বিচারক মানিয়া সকরুণ অভিযোগের অবতারণা করিত। মহেন্দ্র তাহাকে ঠাট্টা করিলে বা কোনো অসংগত কথা বলিলে সে প্রত্যাশা করিত, বিনোদিনী তাহার হইয়া উপযুক্ত জবাব দিয়া দিবে।

এইরূপে তিনজনের সভা জমিয়া উঠিল।

কিন্তু তাই বলিয়া বিনোদিনীর কাজে শৈথিল্য ছিল না। রাঁধাবাড়া, ঘরকন্না দেখা, রাজলক্ষ্মীর সেবা করা, সমস্ত সে নিঃশেষপূর্বক সমাধা করিয়া তবে আমোদে যোগ দিত। মহেন্দ্র অস্থির হইয়া বলিত, "চাকর-দাসীগুলাকে না কাজ করিতে দিয়া তুমি মাটি করিবে দেখিতেছি।" বিনোদিনী বলিত, "নিজে কাজ না করিয়া মাটি হওয়ার চেয়ে সে ভালো। যাও, তুমি কালেজে যাও।"

মহেন্দ্র। আজ বাদলার দিনটাতে--

বিনোদিনী। না সে হইবে না-- তোমার গাড়ি তৈরি হইয়া আছে-- কালেজে যাইতে হইবে।

মহেন্দ্র। আমি তো গাড়ি বারণ করিয়া দিয়াছিলাম।

বিনোদিনী। আমি বলিয়া দিয়াছি। -- বলিয়া মহেন্দ্রের কালেজে যাইবার কাপড় আনিয়া সম্মুখে উপস্থিত করিল।

মহেন্দ্র। তোমার রাজপুতের ঘরে জন্মানো উচিত ছিল, যুদ্ধকালে আত্মীয়কে বর্ম পরাইয়া দিতে।

আমোদের প্রলোভনে ছুটি লওয়া, পড়া ফাঁকি দেওয়া, বিনোদিনী কোনোমতেই প্রশ্রয় দিত না। তাহার কঠিন শাসনে দিনে দুপুরে অনিয়ত আমোদ একেবারে উঠিয়া গেল, এবং এইরূপে সায়াহ্নের অবকাশ মহেন্দ্রের কাছে অত্যন্ত রমণীয় লোভনীয় হইয়া উঠিল। তাহার দিনটা নিজের অবসানের জন্য যেন প্রতীক্ষা করিয়া থাকিত।

পূর্বে মাঝে মাঝে ঠিক সময়মত আহার প্রস্তুত হইত না এবং সেই ছুতা করিয়া মহেন্দ্র আনন্দে কালেজ কামাই করিত। এখন বিনোদিনী স্বয়ং বন্দোবস্ত করিয়া মহেন্দ্রের কালেজের খাওয়া সকাল-সকাল ঠিক করিয়া দেয় এবং খাওয়া হইলেই মহেন্দ্র খবর পায়-- গাড়ি তৈয়ার। পূর্বে কাপড়গুলি প্রতিদিন এমন ভাঁজ-করা পরিপাটি অবস্থায় পাওয়া দূরে থাক্‌, ধোপার বাড়ি গেছে কি আলমারির কোনো-একটা অনির্দেশ্য স্থানে আগোচরে পড়িয়া আছে, তাহা দীর্ঘকাল সন্ধান ব্যতীত জানা যাইত না।

প্রথম-প্রথম বিনোদিনী এই-সকল বিশৃঙ্খলা লইয়া মহেন্দ্রের সম্মুখে আশাকে সহাস্য ভর্ৎসনা করিত--মহেন্দ্রও আশার নিরুপায় নৈপুণ্যহীনতায় সস্নেহে হাসিত। অবশেষে সখিবাৎসল্যবশে আশার হাত হইতে তাহার কর্তব্যভার বিনোদিনী নিজের হাতে কাড়িয়া লইল। ঘরের শ্রী ফিরিয়া গেল।

চাপকানের বোতাম ছিঁড়িয়া গেছে, আশা আশু তাহার কোনো উপায় করিতে পারিতেছে না-- বিনোদিনী দ্রুত আসিয়া হতবুদ্ধি আশার হাত হইতে চাপকান কাড়িয়া লইয়া চটপট সেলাই করিয়া দেয়। একদিন মহেন্দ্রের প্রস্তুত অন্নে বিড়ালে মুখ দিল--আশা ভাবিয়া অস্থির; বিনোদিনী তখনই রান্নাঘরে গিয়া কোথা হইতে কী সংগ্রহ করিয়া গুছাইয়া কাজ চালাইয়া দিল; আশা আশ্চর্য হইয়া গেল।

মহেন্দ্র এইরূপে আহারে ও আচ্ছাদনে, কর্মে ও বিশ্রামে, সর্বত্রই নানা আকারে বিনোদিনীর সেবাহস্ত অনুভব করিতে লাগিল। বিনোদিনীর রচিত পশমের জুতা তাহার পায়ে এবং বিনোদিনীর বোনা পশমের গলাবন্ধ তাহার কণ্ঠদেশে একটা যেন কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করিল। আশা আজকাল সখিহস্তের প্রসাধনে পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন হইয়া সুন্দরবেশে সুগন্ধ-মাখিয়া মহেন্দ্রের নিকট উপস্থিত হয়, তাহার মধ্যে যেন কতকটা আশার নিজের, কতকটা আর-একজনের-- তাহার সাজসজ্জা-সৌন্দর্যে আনন্দে সে যেন গঙ্গাযমুনার মতো তাহার সখীর সঙ্গে মিলিয়া গেছে।

বিহারীর আজকাল পূর্বের মতো আদর নাই-- তাহার ডাক পড়ে না। বিহারী মহেন্দ্রকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিল, কাল রবিবার আছে, দুপুরবেলা আসিয়া সে মহেন্দ্রের মার রান্না খাইবে। মহেন্দ্র দেখিল রবিবারটা নিতান্ত মাটি হয়, তাড়াতাড়ি লিখিয়া পাঠাইল, রবিবারে বিশেষ কাজে তাহাকে বাহিরে যাইতে হইবে।

তবু বিহারী আহারান্তে একবার মহেন্দ্রের বাড়ির খোঁজ লইতে আসিল। বেহারার কাছে শুনিল, মহেন্দ্র বাড়ি হইতে বাহিরে যায় নাই। "মহিনদা" বলিয়া সিঁড়ি হইতে হাঁকিয়া বিহারী মহেন্দ্রের ঘরে গেল। মহেন্দ্র অপ্রস্তুত হইয়া কহিল,"ভারি মাথা ধরিয়াছে।" বলিয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া পড়িল। আশা সে কথা শুনিয়া এবং মহেন্দ্রের মুখের ভাব দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া উঠিল-- কী করা কর্তব্য, স্থির করিবার জন্য বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। বিনোদিনী বেশ জানিত ব্যাপারটা গুরুতর নহে, তবু অত্যন্ত উদ্‌বিগ্নভাবে কহিল, "অনেকক্ষণ বসিয়া আছ, একটুখানি শোও। আমি ওডিকলোন আনিয়া দিই।"

মহেন্দ্র বলিল, "থাক্‌, দরকার নাই।"

বিনোদিনী শুনিল না, দ্রুতপদে ওডিকলোন বরফজলে মিশাইয়া উপস্থিত করিল। আশার হাতে ভিজা রুমাল দিয়া কহিল, "মহেন্দ্রবাবুর মাথায় বাঁধিয়া দাও।"

মহেন্দ্র বারবার বলিতে লাগিল, "থাক্‌-না।" বিহারী অবরুদ্ধহাস্যে নীরবে অভিনয় দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্র সগর্বে ভাবিল, "বিহারীটা দেখুক, আমার কত আদর।'

আশা বিহারীর সম্মুখে লজ্জাকম্পিত হস্তে ভালো করিয়া বাঁধিতে পারিল না-- ফোঁটাখানেক ওডিকলোন গড়াইয়া মহেন্দ্রের চোখে পড়িল। বিনোদিনী আশার হাত হইতে রুমাল লইয়া সুনিপুণ করিয়া বাঁধিল এবং আর-একটি বস্ত্রখণ্ডে ওডিকলোন ভিজাইয়া অল্প অল্প করিয়া নিংড়াইয়া দিল-- আশা মাথায় ঘোমটা টানিয়া পাখা করিতে লাগিল।

বিনোদিনী স্নিগ্ধস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, "মহেন্দ্রবাবু, আরাম পাচ্ছেন কি।"

এইরূপে কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বিনোদিনী দ্রুতকটাক্ষে একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া লইল। দেখিল, বিহারীর চক্ষু কৌতুকে হাসিতেছে। সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে প্রহসন। বিনোদিনী বুঝিয়া লইল, এ লোকটিকে ভোলানো সহজ ব্যাপার নহে-- কিছুই ইহার নজর এড়ায় না।

বিহারী হাসিয়া কহিল, "বিনোদ-বোঠান, এমনতরো শুশ্রুষা পাইলে রোগ সারিবে না, বাড়িয়া যাইবে।"

বিনোদিনী। তা কেমন করিয়া জানিব, আমরা মূর্খ মেয়েমানুষ। আপনাদের ডাক্তারিশাস্ত্রে বুঝি এইমতো লেখা আছে।

বিহারী। আছেই তো। সেবা দেখিয়া আমারও কপাল ধরিয়া উঠিতেছে। কিন্তু পোড়াকপালকে বিনা-চিকিৎসাতেই চটপট সারিয়া উঠিতে হয়। মহিনদার কপালের জোর বেশি।

বিনোদিনী ভিজা বস্ত্রখণ্ড রাখিয়া দিয়া কহিল, "কাজ নাই, বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুতেই করুন।"

বিহারী সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এ কয়দিন সে অধ্যয়নে ব্যস্ত ছিল, ইতিমধ্যে মহেন্দ্র বিনোদিনী ও আশায় মিলিয়া আপনা আপনি যে এতখানি তাল পাকাইয়া তুলিয়াছে তাহা সে জানিত না। আজ সে বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়া দেখিল, বিনোদিনীও তাহাকে দেখিয়া লইল।

বিহারী কিছু তীক্ষ্ণস্বরে কহিল, "ঠিক কথা। বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুই করিবে। আমিই মাথাধরা আনিয়াছিলাম, আমি তাহা সঙ্গে লইয়া চলিলাম। ওডিকলোন আর বাজে খরচ করিবেন না।" আশার দিকে চাহিয়া কহিল, "বোঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।"