Nouka Dubi - 49 in Bengali Fiction Stories by Rabindranath Tagore books and stories PDF | নৌকা ডুবি - 49

Featured Books
Categories
Share

নৌকা ডুবি - 49

49

৪৯

ক্ষেমংকরী পুনর্বার জ্বরে পড়িলেন। এবারকার জ্বর অল্পের উপর দিয়া কাটিয়া গেল। সকালবেলায় নলিনাক্ষ প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইবার সময় বলিল, "মা, তোমাকে কিছুকাল রোগীর নিয়মে থাকিতে হইবে। দুর্বল শরীরের উপর কঠোরতা সহ্য হয় না।"

ক্ষেমংকরী কহিলেন, "আমি রোগীর নিয়মে থাকিব, আর তুমিই যোগীর নিয়মে থাকিবে। নলিন, তোমার ও-সমস্ত আর বেশি দিন চলিবে না। আমি আদেশ করিতেছি, তোমাকে এবার বিবাহ করিতেই হইবে।"

নলিনাক্ষ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ক্ষেমংকরী কহিলেন, "দেখো বাছা, আমার এ শরীর আর গড়িবে না; এখন তোমাকে আমি সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে মনের সুখে মরিতে পারিব। আগে মনে করিতাম একটি ছোটো ফুট্‌ফুটে বউ আমার ঘরে আসিবে, আমি তাহাকে নিজের হাতে শিখাইয়া-পড়াইয়া মানুষ করিয়া তুলিব, তাহাকে সাজাইয়া গুজাইয়া মনের সুখে থাকিব। কিন্তু এবার ব্যামোর সময় ভগবান আমাকে চৈতন্য দিয়াছেন। নিজের আয়ুর উপরে এতটা বিশ্বাস রাখা চলে না, আমি কবে আছি কবে নাই তার ঠিকানা কী। একটি ছোটো মেয়েকে তোমার ঘাড়ের উপর ফেলিয়া গেলে সে আরো বেশি মুশকিল হইবে। তার চেয়ে তোমাদের নিজেদের মতে বড়ো বয়সের মেয়েই বিবাহ করো। জ্বরের সময় এই-সব কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার রাত্রে ঘুম হইত না। আমি বেশ বুঝিয়াছি এই আমার শেষ কাজ বাকি আছে, এইটি সম্পন্ন করিবার অপেক্ষাতেই আমাকে বাঁচিতে হইবে, নহিলে আমি শান্তি পাইব না।"

নলিনাক্ষ। আমাদের সঙ্গে মিশ খাইবে, এমন পাত্রী পাইব কোথায়?

ক্ষেমংকরী কহিলেন, "আচ্ছা, সে আমি ঠিক করিয়া তোমাকে বলিব এখন, সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না।"

আজ পর্যন্ত ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুর সম্মুখে বাহির হন নাই। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে প্রাত্যহিক নিয়মানুসারে বেড়াইতে বেড়াইতে অন্নদাবাবু যখন নলিনাক্ষের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন তখন ক্ষেমংকরী অন্নদাবাবুকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাঁহাকে কহিলেন, "আপনার মেয়েটি বড়ো লক্ষ্মী, তাহার 'পরে আমার বড়োই স্নেহ পড়িয়াছে। আমার নলিনকে তো আপনার জানেন, সে ছেলের কোনো দোষ কেহ দিতে পারিবে না--ডাক্তারিতেও তাহার বেশ নাম আছে। আপনার মেয়ের জন্য এমনতরো সম্বন্ধ কি শীঘ্র খুঁজিয়া পাইবেন?"

অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, "বলেন কী। এমনতরো কথা আশা করিতেও আমার সাহস হয় নাই। নলিনাক্ষের সঙ্গে আমার মেয়ের যদি বিবাহ হয়, তবে তার অপেক্ষা সৌভাগ্য আমার কী হইতে পারে। কিন্তু তিনি কি--"

 

ক্ষেমংকরী কহিলেন, "নলিন আপত্তি করিবে না। সে এখনকার ছেলেদের মতো নয়, সে আমার কথা মানে। আর, এর মধ্যে পীড়াপীড়ির কথাই বা কী আছে। আপনার মেয়েটিকে পছন্দ না করিবে কে? কিন্তু এই কাজটি আমি অতি শীঘ্রই সারিতে চাই। আমার শরীরের গতিক ভালো বুঝিতেছি না।"

সে রাত্রে অন্নদাবাবু উৎফুল্ল হইয়া বাড়িতে গেলেন। সেই রাত্রেই তিনি হেমনলিনীকে ডাকিয়া কহিলেন, "মা, আমার বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, আমার শরীরও ইদানীং ভালো চলিতেছে না। তোমার একটা স্থিতি না করিয়া যাইতে পারিলে আমার মনে সুখ নাই। হেম, আমার কাছে লজ্জা করিলে চলিবে না; তোমার মা নাই, এখন তোমার সমস্ত ভার আমার উপরে।"

হেমনলিনী উৎকণ্ঠিত হইয়া তাহার পিতার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

অন্নদাবাবু কহিলেন, "মা, তোমার জন্য এমন একটি সম্বন্ধ আসিয়াছে যে,মনের আনন্দ আমি আর রাখিতে পারিতেছি না। আমার কেবলই ভয় হইতেছে, পাছে কোনো বিঘ্ন ঘটে। আজ নলিনাক্ষের মা নিজে আমাকে ডাকিয়া তাঁহার পুত্রের সঙ্গে তোমার বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছেন।"

হেমনলিনী মুখ লাল করিয়া অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া কহিল, "বাবা, তুমি কী বল! না না, এ কখনো হইতেই পারে না।"

নলিনাক্ষকে যে কখনো বিবাহ করা যাইতে পারে, এ সম্ভাবনার সন্দেহমাত্র হেমনলিনীর মাথায় আসে নাই। হঠাৎ পিতার মুখে এই প্রস্তাব শুনিয়া তাহাকে লজ্জায়-সংকোচে অস্থির করিয়া তুলিল।

অন্নদাবাবু প্রশ্ন করলেন, "কেন হইতে পারে না?"

হেমনলিনী কহিল, "নলিনাক্ষবাবু! এও কি কখনো হয়!" এরূপ উত্তরকে ঠিক যুক্তি বলা চলে না, কিন্তু যুক্তির অপেক্ষা ইহা অনেক গুণে প্রবল।

হেম আর থাকিতে পারিল না, সে বারান্দায় চলিয়া গেল।

অন্নদাবাবু অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িলেন। তিনি এরূপ বাধার কথা কল্পনাও করেন নাই। বরঞ্চ তাঁহার ধারণা ছিল, নলিনাক্ষের সহিত বিবাহের প্রস্তাবে হেম মনে মনে খুশিই হইবে। হতবুদ্ধি বৃদ্ধ বিষণ্নমুখে কেরোসিনের আলোর দিকে চাহিয়া স্ত্রীপ্রকৃতির অচিন্তনীয় রহস্য ও হেমনলিনীর জননীর অভাব মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন।

হেম অনেকক্ষণ বারান্দার অন্ধকারে বসিয়া রহিল। তাহার পরে ঘরের দিকে চাহিয়া তাহার পিতার নিতান্ত হতাশ মুখের ভাব চোখে পড়িতেই তাহার মনে বাজিল। তাড়াতাড়ি তাহার পিতার চৌকির পশ্চাতে দাঁড়াইয়া তাঁহার মাথায় অঙ্গুলিসঞ্চালন করিতে করিতে কহিল, "বাবা চলো, অনেকক্ষণ খাবার দিয়াছে, খাবার ঠাণ্ডা হইয়া গেল।"

অন্নদাবাবু যন্ত্রচালিতবৎ উঠিয়া খাবারের জায়গায় গেলেন, কিন্তু ভালো করিয়া খাইতেই পারিলেন না। হেমনলিনী সম্বন্ধে সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়া গেল মনে করিয়া তিনি বড়োই আশান্বিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু হেমনলিনীর দিক হইতেই যে এতবড়ো ব্যাঘাত আসিল ইহাতে তিনি অত্যন্ত দমিয়া গেছেন। আবার তিনি ব্যাকুল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে ভাবিলেন, হেম তবে এখনো রমেশকে ভুলিতে পারে নাই।

অন্য দিন আহারের পরেই অন্নদাবাবু শুইতে যাইতেন, আজ বারান্দায় ক্যাম্‌বিসের কেদারার উপরে বসিয়া বাড়ির বাগানের সম্মুখবর্তী ক্যাণ্টন্‌মেণ্টের নির্জন রাস্তার দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন। হেমনলিনী আসিয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিল, "বাবা, এখানে বড়ো ঠাণ্ডা, শুইতে চলো।"

অন্নদা কহিলেন, "তুমি শুইতে যাও, আমি একটু পরেই যাইতেছি।"

হেমনলিনী চুপ করিয়া তাঁহার পাশে দাঁড়াইয়া রহিল। আবার খানিক বাদেই কহিল, "বাবা, তোমার ঠাণ্ডা লাগিতেছে, নাহয় বসিবার ঘরেই চলো।"

তখন অন্নদাবাবু চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া, কিছু না বলিয়া শুইতে গেলেন।

পাছে তাহার কর্তব্যের ক্ষতি হয় বলিয়া হেমনলিনী রমেশের কথা মনে মনে আন্দোলন করিয়া নিজেকে পীড়িত হইতে দেয় না। এজন্য এ পর্যন্ত সে নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করিয়া আসিতেছে। কিন্তু বাহির হইতে যখন টান পড়ে তখন ক্ষতস্থানের সমস্ত বেদনা জাগিয়া উঠে। হেমনলিনীর ভবিষ্যৎ জীবনটা যে কী ভাবে চলিবে তাহা এ পর্যন্ত সে পরিষ্কার কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, এই কারণেই একটা সুদৃঢ় কোনো অবলম্বন খুঁজিয়া অবশেষে নলিনাক্ষকে গুরু মানিয়া তাহার উপদেশ অনুসারে চলিতে প্রস্তুত হইয়াছিল। কিন্তু যখনই বিবাহের প্রস্তাবে তাহাকে তাহার হৃদয়ের গভীরতম দেশের আশ্রয়সূত্র হইতে টানিয়া আনিতে চাহে তখনই সে বুঝিতে পারে, সে বন্ধন কী কঠিন! তাহাকে কেহ ছিন্ন করিতে আসিলেই হেমনলিনীর সমস্ত মন ব্যাকুল হইয়া সেই বন্ধনকে দ্বিগুণবলে আঁকড়িয়া ধরিতে চেষ্টা করে।