রাত্রের ঘন মেঘে কালো হয়ে আসা আকাশের নিচে বন্ধুর পার্বত্য জঙ্গলাকীর্ণ পথ দ্রুত পার হয়ে ছুটে চলছিল এক অশ্ব। বনানীর ঘোর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে আবছা ভাবে দেখা গেল, তাতে এক আরোহী ও আছেন। উষ্ণীষ এর কাপড়ে মুখ ঢাকা। বনপথ থেকে বেরিয়ে সে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো নদীর দিকে। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে কি যেন দেখলো সে। দেখা গেল না কিছু। এতক্ষনে অশ্বের বেগ কমাতে লাগাম টেনে ধরলো সে। ঘোড়াখানি থামতে সে নেমে এলো। একটু এগিয়ে দেখতে পেল নদী। এতক্ষনে মুখ থেকে কাপড় সরল ।নদীর পাড়ে বসে আঁজলা ভরে জল খেলো সে। তৃষ্ণা নিবারণ করে উঠে দাঁড়াতেই শরীর আর ধকল নিতে পারলো না। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।। প্রভাতী সূর্য যখন তার কাঁচা সোনা রঙে সাজাচ্ছিলো নদীকে, তখন নদীর তিরতির করে বয়ে চলা নদীর বুকে কয়েকটা ডিঙি মাছ ধরছিল। একটা ডিঙি হঠাৎ দেখতে পেল পারে পড়ে থাকা মানুষ টিকে।কাছে যেতে বোঝা গেল অশ্বারোহী, অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। তবে ঘোড়াটির দেখা পাওয়া গেলো না। ডিঙির লোকেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তুলে নিলো নিজেদের ডিঙিতে তাকে।গন্তব্য রাজবাড়ী। রাজপ্রাসাদের অতিথিগৃহ এখন ব্যস্তসমস্ত। রাজবৈদ্য আছেন, আছেন স্বয়ং মহারাজ রাজনারায়ন , রানী বিম্ববতী, রাজপুত্র রুদ্রনারায়ণ। নবাগত অচেনা ব্যাক্তিটির শুশ্রুষা চলছে। অবশ্য ব্যাক্তি বলা ভুল, নারীটির। হ্যাঁ , অশ্বারোহী এক নারী। আপাতত তাঁর জ্ঞান ফেরেনি। রাজবৈদ্য র কথা অনুসারে অতিরিক্ত ধকলের কারণে এই অসুস্থতা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। .......... বেশ খানিকক্ষণ পরে সত্যিই তাঁর জ্ঞান ফিরে এলো। বলাবাহুল্য তার ডাক পড়লো রাজ দরবারে। " কাল রাতে সম্ভবত তুমি এই রাজ্যে পদার্পন করেছ, নদীর ধারে তোমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। তারপর এই মাত্র তোমার জ্ঞান ফিরেছে। তোমায় জানিয়ে রাখি বর্তমানে তুমি কপোত কূট রাজ্যে অবস্থান করছো। আমি মহারাজ রাজনারায়ন, এই যুবরাজ রুদ্রনারায়ন।এবার তুমি তোমার পরিচয় দাও।" " মহারাজ, বিনা অনুমতিতে আমি আপনার রাজ্যে প্রবেশ করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আমার আর উপায় ছিল না। আমি আপনার ই রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তের এক ক্ষুদ্র রাজ্য কুশল দেশের বণিক গ্রহকেতুর কন্যা মঞ্জিরা। আমার পিতা সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতেন, বস্ত্রের। এক পক্ষকাল আগে পিতা বাণিজ্য করে ফেরার পথে ওনার ব্যাবসার প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বারা নিহত হন। শুধু তাই নয়, ওরা আমাকেও প্রাণে মেরে ফেলার প্রয়াস চালায়। আমি প্রাণ বাঁচাতে তাই ঘোড়ায় করে বেরিয়ে পড়ি। তারপর আর জানিনা, কত পথ অতিক্রম করেছি। পথে খাদ্যের অভাব , পানীয়ের অভাব, তাই এতদিন ক্রমাগত ঘুরে মনে হলো ওদের নাগালের এড়াতে পেরেছি, তাই এই নদীর ধারে বসে তৃষ্ণা নিবারণ করছিলাম, এখন আপনার কাছে আশ্রয় ভিক্ষা চাইছি।" মহারাজ কিছুক্ষন ভেবে বললেন, " বেশ, যতদিন না তোমার ওপর থেকে বিপদের ছায়া আমি সরাতে পারছি, ততদিন তুমি আমার আশ্রয়ে থাকবে।" যুবরাজ বললেন, " প্রহরী, ওনাকে ওনার কক্ষ দেখিয়ে দাও।আর দাসীদের বলো, ওনার বিশেষ যত্ন নিতে, উনি অসুস্থ।" বেশ কিছুদিন কাটে, মঞ্জিরা এই রাজপ্রাসাদের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়। মহারাজ, রানিমার স্নেহ পায়, তবুও ওর মন যেন চঞ্চল কুরঙ্গীর মতো অস্থির হয়ে থাকে।একদিন, গোধূলির শেষ রক্তিম আলোয় মঞ্জিরা প্রাসাদের ছাদে একাকী এসে দাঁড়ায়। মুখের নির্লিপ্ত ভাবে অসংখ্য চিন্তার ঢেউ খেলে যায়। সন্ধে হলে ও গৃহে ফিরে আসে। দুই চারদিন পরে রানিমার পান সেজে দেওয়ার মাঝে কথা প্রসঙ্গে বলে ওঠেন," ইস, তোর মত যদি একটা মেয়েকে আমার পুত্রবধূ হিসেবে পেতাম রে, মহারাজ তো শোনার পাত্র নন, উনি ছেলের বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন ওনার মিত্র মহারাজ গ্রহবর্মার একমাত্র কন্যা মৃগাঙ্কিকার সাথে। জানিনা সে মেয়ে কেমন।" মঞ্জিরা খানিক অবাক হয়, " কিবলছেন রানিমা, যুবরাজের বিয়ে?কবে? কই রাজপ্রাসাদের বাকি কেউ তো আর জানে না। " " না রে, আর কেউ জানবেও না, একেবারে বৈবাহিক কার্য সম্পন্ন করে তবেই সবাই জানবে, না হলে যদি এখন জানাজানি হয়ে যায়, যে কপোত কুটের যুবরাজ সয়ম্বর ছাড়াই বিবাহ করছেন, তাহলে আর নিস্তার নেই। তুইও কাউকে বলিস না।"
রানিমার আদেশে আজ মঞ্জিরা যুবরাজের সাথে মন্দিরে এসেছে, বিবাহের পূর্বের এ রাজ্যের রীতি অনুসারে কুমারী পূজা করতে। এই মতে কোনো কুমারী মেয়েকে শুভ তিথি মেনে সারাদিন উপবাস রেখে বিকেলে কুলদেবীর মন্দিরে পুজো দিতে হয়, তারপর সেই পুজোর প্রসাদ সর্বাগ্রে যার বিবাহ হবে সেই পুরুষের কাছে সমর্পন করতে হয়, এই দায়িত্ব পড়েছে মঞ্জিরার ওপর। যাই হোক,, বিকেলে পুজো দিয়ে ফিরে আসার সময় হঠাৎ যুবরাজ বললেন, চলুন একটু নদীর ধারে যাই, ওখানে এক সাধুবাবার আশ্রম আছে, তাঁর সাক্ষাৎ করে আসি। দুজনে নদীর ধারে পৌঁছতেই রাজপুত্র চেপে ধরলেন মঞ্জিরার হাত খানা, মঞ্জিরা সভয়ে বললো, " কি করছেন যুবরাজ, হাত ছাড়ুন" যুবরাজ হাত টা ধরে আরো কাছে এগিয়ে এলেন, ফিসফিস করে প্রগলভ হয়ে বললেন , " তুমি এত সাহসী, এত বুদ্ধিমতী, সকলের এত যত্ন নাও, আর এক পুরুষের মনের কথা টুকু জানতে পারো না ?""কে? কার কথা বলছেন?" " আমার, তুমি সত্যি জানো না , আমার হৃদয়ে কি আছে ?" " যুবরাজ আজ বাদে কাল আপনার বিয়ে, আপনার বাগদত্তা আপনার অপেক্ষায় আর আপনি এখন ......" " আমার তাতে কিছু যায় আসে না, আমি ওকে বহুদিন চিনি, আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসে, আমিও ওকে ভালোবাসতাম, কিন্তু বিশ্বাস করো, যেদিন তোমাকে দেখলাম সেদিন আমার সব হিসেব গুলিয়ে গেল, বলো না, তুমি আমার জীবন সঙ্গিনী হবে তো ?"" মঞ্জিরা কিছুক্ষন নত শির থেকে জবাব দিলো, হ্যাঁ, ..... কিন্তু মহারাজ, রানিমা .....… " " তোমাকে পেতে আমি সব করতে রাজি , দরকার হলে আমি কাল সকাল হওয়ার আগেই তোমায় নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো,মঞ্জিরা , আমরা একে অপরকে নিয়ে সুখে থাকবো .."" কিন্তু....." আর কোনো কিন্তু নয়, তুমি তৈরি থেকো, আমি আসবো। যুবরাজ এগিয়ে গেলেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মঞ্জিরা, চোখে কিসের যেন ঝিলিক দিলো।। গভীর রাত, আকাশের কালো চাদরে আজ অসংখ্য তারার মনি ছড়ানো , বনপথে উঁচু নিচু পাহাড়ি অঞ্চল পেরিয়ে ছুটে চলেছে এক অশ্ব , ঘোড়ার লাগাম ধরে আছে মঞ্জিরা, ওরফে রাজকুমারী মৃগাঙ্কিকা। এবার তাঁর যাত্রাপথ কুশল রাজ্যের দিকে, ভোরের আলো ফোটার আগেই তাকে পিতার কাছে পৌঁছাতে হবে, বলতে হবে এই বিবাহ তিনি করবেন না। তাঁর হবু স্বামী কেমন চরিত্রের মানুষ তা জানার বাসনা তে তিনি এই ছদ্মনাম , ছদ্মবেশ নেন, ..... আর যাই হোক যে পুরুষ কয়েকদিনের এক অপরিচিত মেয়ের রূপের মোহে নিজের পরিবার, রাজকর্তব্য নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে পারে, স্বার্থপরের মতো নিজের বাগদত্তার প্রেম কে তুচ্ছ করতে পারে, তার সাথে মৃগাঙ্কিকা কিছুতেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন না, সে এক নারীর দৃষ্টিকোণ দিয়েই হোক, বা এক আগামী প্রজাপালকের দায়িত্ববোধের দৃষ্টি দিয়ে।।