আজ সকাল থেকেই অর্ক পিকনিকে যাবার জেদ ধরেছে । নন্দিনী অর্ককে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্ত অর্ক কিছুতেই রাজি নয় । পাশের ঘরের সোফাতে বসে সৈকত সকালের নিউজ পেপারটা পড়ছিল । অর্ক যখন বুঝতে পারল মা এর কাছে ওর জেদ পূরণ হবে না তখন অর্ক পাশের ঘরে থাকা ওর বাবা অর্থাৎ সৈকতকে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ।
সৈকত অর্ককে জিজ্ঞাসা করল , কি ব্যাপার অর্ক ?
অর্ক বলল , আজ আমাকে পিকনিকে নিয়ে যেতে হবে !
সৈকত বলল , না ... অর্ক , আজ একবারেই সম্ভব নয় । আজ আমার অফিসে একটা গুরুত্ব পূর্ণ মিটিং আছে । আজ হবে না । আমরা না হয় অন্য কোনও দিন যাব ।
অর্ক বলল , না ......... আমাকে আজকেই পিকনিকে নিয়ে যেতে হবে ।
সৈকত বলল , না অর্ক । প্লিজ তুমি বোঝার চেষ্টা করো ।
তখন নন্দিনী পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সৈকতকে বলল , আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্ত ও কিছুতেই রাজি নয় । আজ ওকে পিকনিকে নিয়ে যেতেই হবে । তোমার ছেলে তোমার মতই জেদি । এখন নাও তোমার ছেলেকে তুমিই সামলাও ।
এই বলে নন্দিনী চলে গেলো ।
সৈকত অর্ককে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্ত অবশেষে অর্কর জেদের কাছে সৈকতকে হার স্বীকার করতেই হল ।
তারপর আর কি সৈকতকে বাধ্য হয়ে সেই দিনকার অফিসের মিটিংটা বাতিল করলো এবং আশেপাশের পিকনিক স্পটে ওদের তিনজন কার জন্য বুকিং করলো ।
ব্যাস ......... এরপর ওরা তিনজন সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পিকনিকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল ।
দুই
সারাটা দিন কখন যে কেটে গিয়ে সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত গিয়েছে ওরা তিনজন একেবারেই বুঝতে পারেনি | সৈকত যখন ওর হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা বাজে |
সৈকত নন্দিনী আর অর্কর উদ্দেশে বলল , এবার আমাদের যেতে হবে !
নন্দিনী সৈকত এর কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে গাড়ির ডিকিতে রেখে দিল । এরপর ওরা তিনজনে গাড়িতে গিয়ে বসলো | সৈকত আর একটুও সময় নষ্ট না করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটিয়ে দিল ।
খানিকটা দূর যাবার পর সৈকতকে গাড়িটা থামাতে হলো | সামনের হাইওয়েতে বেশ যান-জট । সৈকত দেখল সামনের হাইওয়েতে একের পর এক গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে । সৈকতও সকলের মতো ওর গাড়িটাকেও রাস্তার একধারে দাঁড় করালও এবং পথ চলতি একটা লোককে ডেকে সৈকত জিজ্ঞাসা করল , আচ্ছা মশাই আপনি কি বলতে পারবেন সামনের হাইওয়েতে কীসের জন্য এতো যানজট ?
পথচলতি লোকটা ওদের তিনজন কার দিকে একবার তাকাল এবং তারপর বলল , সামনের রাস্তার মোড়ে একটা গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে । ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছে এবং ওরা তদন্ত শুরু করেছে । পুলিশের বক্তব্য যতক্ষণ না পর্যন্ত ওদের তদন্ত সম্পূর্ণ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা কোন গাড়িকেই যেতে দেবে না । যার জন্যই এতো যানজট ।
লোকটার কথা শুনে সৈকত আর নন্দিনী একে অপরের মুখের দিকে তাকাল তারপর সৈকত লোকটাকে বলল , আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ !
লোকটা একটু মুচকি হেসে সামনের রাস্তার ভিড়ে মিলিয়ে গেল ।
গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে প্রায় দু ঘণ্টা কেটে গেলো । যানজট আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে । সৈকত ভাবছিল কি করা যায় তখনই ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এল । সৈকত তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ওর ফোনটা বার করে ফোনের ম্যাপ অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করে বাড়ি যাবার জন্য অন্য রাস্তা খুঁজতে লাগল ।
ম্যাপটাকে মনোযোগ সহকারে দেখতে দেখতে সৈকত একটা হাইওয়ে দেখতে পেলো । ম্যাপটাকে জুম করে সৈকত আরও ভাল করে দেখার চেষ্টা করল কিন্ত ম্যাপে ওই হাইওয়ে সম্পর্কে কোন তথ্য খুঁজে পেলো না । সৈকতের মনে হল হয়তো হাইওয়ে টা সবে নতুন তৈরি হয়েছে যার জন্যই হয়তো ম্যাপে ওর সম্পর্কে কোন তথ্য আপলোড করা নেই । যাই হোক সৈকত ম্যাপের দেখানো পথ অনুসরণ করে চলতে লাগলো ।
সৈকত গাড়িতে স্টার্ট দিল । তারপর গাড়িটাকে ব্যাক গিয়ারে দিয়ে বেশ খানিকটা পিছনে নিয়ে গিয়ে তারপর গাড়িটাকে ডানদিকে ঘুড়িয়ে দিয়ে সোজা চলতে লাগলো ।
নন্দিনী সৈকতকে জিজ্ঞাসা করল , আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
জবাবে সৈকত বলল , ম্যাপেতে বাড়ি যাবার জন্য একটা অন্য হাইওয়ে দেখতে পেয়েছি আমরা সেখানেই যাচ্ছি । এখান থেকে মাত্র আধ ঘণ্টার পথ ।
তিন
ওরা যখন সেই হাইওয়ের কাছে পোঁছলো তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা বাজে । হাইওয়েতে ঢোকার মুখেই একটা কাঠের বোর্ডে বড় বড় করে লাল কালি দিয়ে পরিষ্কার বাংলা অক্ষরে লেখা আছে একটা সতর্কতাবানী । নন্দিনী আর সৈকত সেই সতর্কতাবানীটা পড়ল ।
তাতে লেখা আছে “ রাত্রিবেলায় এই হাইওয়ে মানুষের জন্য একেবারেই নিরাপদ নয় “
সতর্কতাবানীটা পড়ার পর থেকেই নন্দিনীর কেমন যেনও ভয় করতে লাগলো । নন্দিনীর মনে হল ওর জীবনে যেন কোন বড় অঘটন ঘটতে চলেছে । নন্দিনী সৈকতকে এই হাইওয়ে দিয়ে যেতে বারন করল কিন্ত সৈকত ওই সতর্কতাবানী কে উপেক্ষা করেই গাড়ি ছুটিয়ে দিলও ।
ওরা শহরের জমজমাট থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে । সৈকত লক্ষ্য করল আশেপাশের পরিবেশ কেমন যেন শান্ত আর নিস্তব্ধ । হাইওয়ের দুপাশে বড় বড় গাছ । প্রতিটা গাছের পাতায় জোনাকির আলো ঝিকমিক করছে । কেবলমাত্র ওদের গাড়িটাই এই শান্ত আর নিস্তব্ধ পরিবেশ ভেদ করে সামনের দিকে ছুটে চলেছে ।
বেশ কিছুটা দূরে যাবার পর হটাতই গাড়িটা ওদের তিনজনকে বার তিনেক ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো । সৈকত গাড়িটাকে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল কিন্ত শেষ পর্যন্ত যখন গাড়িটা স্টার্ট হল না তখন সৈকত নিজেই বাইরে বেরিয়ে দেখল গাড়িটা কি জন্য বন্ধ হয়েছে ।
সৈকত দেখল গাড়ির পিছনের দুটো চাকা পাংচার হয়ে গেছে । সৈকত গাড়ির মেকানিককে ফোন করল কিন্ত ফোন লাগলো না । ফোন লাগবে কি করে সৈকতের ফোনে নেটওয়ার্ক ছিল না ।
সৈকত নন্দিনী কে জিজ্ঞাসা করল , তোমার ফোনে নেটওয়ার্ক আছে ?
নন্দিনী ফোনটা অন করে দেখল তারপর বলল , না ... আমার ফোনেও নেটওয়ার্ক নেই ।
সৈকত আশপাশটা ভালো করে দেখল । দুর-দুর পর্যন্ত কাউকে দেখতে পেলো না । যেদিকে চোখ যায় সেদিকে ঘুট-ঘুটে অন্ধকার ।
অগত্যা সৈকত গাড়িতে গিয়ে বসলো এবং এই হাইওয়ে দিয়ে অন্য গাড়ি যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ।
নন্দিনী একটু রেগেমেগে সৈকত কে বলল , আমি তোমাকে এই হাইওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করতে বারন করেছিলাম কিন্ত তুমি আমার কোনও কথাই শুনলে না ।
সৈকত বলল , রিলেক্স ... ! সব ঠিক হয়ে যাবে ।
অপেক্ষা করতে করতে প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেলো । সৈকত যখন দেখল এই হাইওয়ে দিয়ে আর অন্য কোনও গাড়ি এলো না তখন সৈকত নিজেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল ।
নন্দিনী বলল , তুমি কোথায় যাচ্ছ ?
সৈকত বলল , দেখি আশে পাশে যদি কাউকে দেখতে পাই তাহলে তাকে আমাদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ করব ।
নন্দিনী সৈকতের হাত ধরে বলল , একা একা যেও না প্লিজ ! আমরা তিনজনে আজকের রাত্রিটা ঠিক ম্যানেজ করে নেবো । কাল সকালে না হয় তুমি ...... ।
সৈকত বলল , তুমি চিন্তা করো না । আমার কিচ্ছু হবে না .........।
এই বলে সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সৈকত সেই অন্ধকারের মধ্যে যেনও মিলিয়ে গেলো ।
চার
প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় অতিক্রম হয়ে যাবার পরেও যখন সৈকত ফিরে এলো না তখন নন্দিনীকে একটা চাপা অস্বস্তি ধীরে ধীরে জড়িয়ে ধরতে শুরু করল । নন্দিনীর বার বার মনে হতে লাগল একটা অজানা ভয় যেন ওকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে । নন্দিনী গাড়ির জানলা দিয়ে একবার বাইরের দিকে তাকাল । চারিদিকে ঘুটঘুটে গাড় অন্ধকার । আশেপাশের রাস্তা পুরো শুনশান কোনও মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই আর ওদের গাড়িটা এই শুনশান রাস্তার পুরো মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে । নন্দিনীর বেশ ভয় লাগছিলো । নন্দিনী কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না তাই ও সৈকত কে ফোন করল কিন্ত সৈকত এর ফোনটা যখন বার বার বেজে কেটে যাচ্ছিলো তখন সৈকত এর জন্য নন্দিনীর বেশ চিন্তা হতে লাগল ।
এমন পরিস্থিতিতে কি করা যায় সেটাই নন্দিনী ভাবছিল আর ঠিক এমন সময় একটা শব্দে নন্দিনী চমকে উঠল । শব্দটা আসছে গাড়ির ছাদ থেকে । উপর থেকে কোন ভারী জিনিসের পড়ার আওয়াজ । প্রথমে নন্দিনীর মনে হল হয়ত কোনও রাতচরা পাখি গাছের ডালে মারামারি করতে করতে ওদের গাড়ির ছাদে এসে পড়েছে ।
কিন্ত , না …… নন্দিনীর ধারণা একেবারেই ভুল । ধীরে ধীরে শব্দটা নন্দিনীর কেমন যেন অদ্ভুত রকমের লাগল । নন্দিনীর মনে হল যেন কোনও হিংস্র জন্ত তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং ওদের দুজনকার মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে । সময় যতই এগতে লাগল ততই যেনও শব্দটা ক্রমেই বেড়েই চলল । নন্দিনী অর্ককে বুকে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল । পুরো গাড়িটা যেন শিকার আর শিকারির লড়াইয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো । এইরকম ভয়ানক তাণ্ডব বেশ খানিকক্ষণ চলল । তারপর আবার সব আগের মতই শান্ত হয়ে গেলো ।
আগের মতই আবার সব শান্ত হয়ে গেলেও নন্দিনী আর অর্কর ভয়ের আড়ষ্টটা তখনও কাটেনি । নন্দিনী আর অর্ক তখনও আগের মতই গাড়ির পিছনের শিটে জড়সড় হয়ে বসে ছিল । নন্দিনীর ভয় একটু কাটতে ওর মনে হলও ওর বাঁ কাঁধে উপর কি যেন একটা তরল বস্ত ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে । নন্দিনী ওর কাঁধে হাত দিল । নন্দিনী ওর হাতটা যখন চোখের সামনে নিয়ে এলো তখন ওর বুকটা যেন ধড়াস করে উঠল । নন্দিনী দেখল ওর হাতে রক্ত ...... লেগে রয়েছে । একেবারে টাটকা রক্ত । নন্দিনীর হাত পা থর থর করে কাঁপতে লাগলো । নন্দিনী উপরের দিকে তাকিয়ে দেখল খানিকক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক তাণ্ডব এ ওদের গাড়ির ছাদের বিভিন্ন জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে আর সেই ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত নন্দিনীর কাঁধে এসে পড়ছে । এইসব দেখার পর নন্দিনী আর এক মুহূর্তও গাড়িতে থাকতে পারল না । নন্দিনী আর অর্ক গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সামনে রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগলো । ছুটতে ছুটতে নন্দিনী আর অর্ক বেশ খানিকটা দূরে চলে এলো । অর্ক আর নন্দিনী দুজনেই হাফাতে হাফাতে রাস্তার উপরে বসে পড়ল । এমন সময় খানিকটা দূর থেকে নন্দিনী পুলিশের গাড়ির সাইরেন এর শব্দ শুনতে পেলো । নন্দিনী আর অর্ক কোনরকমে ছুটে গিয়ে পুলিশের গাড়ির সামনে দুহাত তুলে ইশারা করতে লাগলো ।
দূর থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর নন্দিনী আর অর্ককে দেখতে পেয়ে কনস্টেবল কে গাড়ি থামানোর জন্য নির্দেশ দিল । নন্দিনী আর অর্কর থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে পুলিশের গাড়িটা থামল । গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ ইন্সপেক্টর নন্দিনী আর অর্কর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো ।
পুলিশ ইন্সপেক্টর নন্দিনীকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল , আমি লোকাল থানার সাব-ইন্সপেক্টর নিহার ঘোষ । আর …… আপনি ? এত রাত্রে এই শুনশান হাইওয়েতে কি করছেন ?
নিহার ঘোষ কে দেখতে পেয়ে নন্দিনী যেন একটু ভরসা পেলো । তারপর নন্দিনী ওর সঙ্গে একটু আগে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলো পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বলতে লাগল । নন্দিনী লক্ষ্য করল ওর মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর নিহার ঘোষের মুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ।
নিহার ঘোষ একটু গম্ভীর গলায় বলল , আপনাদের এই হাইওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করা একেবারে উচিত হয়নি । বিশেষত রাত্রিবেলায় তো একেবারেই নয় । রাত্রিবেলায় এই হাইওয়ে একেবারেই সুরক্ষিত নয় ।
নন্দিনী নিহার ঘোষ কে জিজ্ঞাসা করল , আপনি কি বলতে চাইছেন ? ঠিক বুঝতে পারলাম না । এই হাইওয়ে কেন সুরক্ষিত নয় ?
নিহার ঘোষ বললো , গত কয়েক মাস ধরে এই হাইওয়েতে রহস্যজনক ভাবে অনেক মানুষ খুন হয়েছে এবং অনেক গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়ছে । প্রথমে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট মনে করেছিলো এটা কোন সিরিয়াল কিলার এর কাজ । যাদের প্রাথমিক মটিভ ছিল একটাই এই হাইওয়ে দিয়ে যাতায়াত কারী সমস্ত মানুষ কে খুন করা এবং খুন করার পর তাদের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দেওয়া । এই সিরিয়াল কিলার কে ধরার জন্য এই হাইওয়ের প্রতিটা লাইট পোস্টে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল কিন্ত অদ্ভুত ব্যাপার হল যখন এই হাইওয়েতে হত্যালীলা চলত তখন সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ডিং ফ্রিজ হয়ে যেত । হত্যালীলা চলাকালীন কোনও কিছুই রেকর্ড হত না । এই রকম ঘটনা দেখে আমারা সকলেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম ।
আশেপাশের স্থানীয় লোকজনদের বিশ্বাস এই সমস্ত খুনের পিছনে এক ভয়ানক দানবের হাত । তবে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এই সব আজগুবি কথায় কখনই বিশ্বাস করেনি আর এটাই ছিলও আমাদের সব থেকে বড় ভুল । তা যাই হোক একদিন আমরা ছয়জন কনস্টেবলকে সারারাত এই হাইওয়েতে পেট্রোলিং করার নির্দেশ দিলাম । প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাক চলছিলো তারপর হটাৎই কেমন যেন সব বদলে যেতে শুরু করলো । ধীরে ধীরে ওই ছয়জন কনস্টেবল দের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে লাগল । আমারা ওদের সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম কিন্ত পারলাম না ।
পরের দিন সকালে আমরা অনেক পুলিশ ফোর্স নিয়ে ওদের খোঁজার জন্য গেলাম । অনেক খোঁজাখুঁজির করার পর এই হাইওয়ের পাশের জঙ্গলে ওদের প্রতেকের ছিন্ন ভিন্ন লাশ গুলো পেলাম ।পরে থানায়ে ফিরে এসে আগের দিন রাতের সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ডিং ক্লিপ গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম এমন সময় একটা ক্লিপ এ আমার চোখ টা আটকে গেলো । আমি দেখলাম এক বিশালকার দানব ছয় জন কনস্টেবলকে ……… । আমি বেশ কিছুক্ষণ হতবাকের বসে রইলাম তারপর সবাইকে এই ক্লিপ টা দেখলাম । সকলেই এই ক্লিপ টা দেখে হতবাক । সকলের মুখেই একটাই প্রশ্ন এটা কি করে সম্ভব ? এই ঘটনার পর থেকে আমার এই হাইওয়ে টা সাধারন মানুষ দের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি আর এই হাইওয়েতে প্রবেশ করার মুখেই আমারা একটা সতর্কতাবানী দিয়ে দিয়েছি ।
আপনি লক্ষ্য করেননি ?
নন্দিনী বলল , হ্যাঁ লক্ষ্য করেছিলাম ।
নিহার ঘোষ বলল , তা সত্ত্বেও আপনি ...... ।
নন্দিনী বলল , আমি আমার হাসবেন্ডকে বারণ করেছিলাম এই হাইওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করতে কিন্ত ও আমার কোন কথা না শুনেই ওই সাবধানতা বাণীকে উপেক্ষা করেই এই হাইওয়েতে ড্রাইভ করেছিল ।
নিহার ঘোষ নন্দিনী কে জিজ্ঞাসা করল , আপনার হাসবেন্ড কোথায় ? ওনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না ?
নন্দিনী বলল , আসলে আমরা যখন এই হাইওয়ে দিয়ে যখন ড্রাইভ করছিলাম তখন হতাথই আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে যায় । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন হাইওয়েতে দিয়ে অন্য কোন গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না তখন আমার হাসবেন্ড বাধ্য হয়েই আসেপাশের লোকজনের থেকে সাহায্যের জন্য বেরিয়ে পড়ে ।
নিহার ঘোষ বলল , ওহ ... মাই গড ! আপনি আপনার হাসবেন্ডকে এত রাত্রে একা একা বাইরে যেতে দিয়েছেন কেন ? রাত্রিবেলা এই হাইওয়ে একেবারেই সুরক্ষিত নয় ।
নন্দিনী ভয়ে ভয়ে বলল , আমি ওকে অনেকবার বারণ করেছিলাম কিন্ত ও আমার কোন কথা শোনেনি ।
নিহার ঘোষ অর্কর দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল , ওকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না ?
নন্দিনী বলল , ও...... আমার ছেলে ...... অর্ক ।
নিহার ঘোষ বলল , ওহ ...।
নিহার ঘোষ আশেপাশে তাকাল এবং তারপর জিজ্ঞাসা করল , আপনাদের গাড়িটা কোথায় ?
নন্দিনী সামনের ফাঁকা রাস্তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো ।
নিহার ঘোষ বলল , ওকে ...... আপনি আমাদের সঙ্গে আমাদের গাড়িতে চলুন ।
নন্দিনী আর একটুও দেরি না করে পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়ল ।
পাঁচ
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পুলিশের গাড়ি ওদের গাড়ির থেকে কয়েক হাত দূরে এসে থামল । নন্দিনী গাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছিল কিন্ত নিহার ঘোষ নন্দিনীকে বাইরে বেরোতে বারন করল ।
নিহার ঘোষ বলল , আপনি গাড়িতেই থাকুন । আমরা দেখে আসছি । দরকার পড়লে আপনাকে ডেকে নেবো ।
নিহার ঘোষের কথা মত নন্দিনী আর অর্ক পুলিশ এর গাড়িতে বসে রইল ।
নিহার ঘোষ আর কনস্টেবল ওরা দুজনে গাড়ি থেকে নামলো । নিহার ঘোষ দেখল রাস্তার স্ট্রীট লাইট টা মাঝে মাঝে জ্বলছে আর নিভছে । নিহার ঘোষ প্যান্টের পকেটে রাখা টর্চ লাইট টা জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল আর কনস্টেবল কে আশেপাশটা ভালো করে তল্লাশি নিতে বলল । কনস্টেবল পকেটে রাখা টর্চটাকে জ্বালিয়ে এদিক ওদিক তল্লাশি চালাতে লাগলো ।
খুঁজতে খুঁজতে কনস্টেবল আশেপাশের মাটিতে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ দেখতে পেলো । কনস্টেবল রক্তের ফোঁটা লক্ষ্য করতে করতে সামনের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলল । বেশ কিছুটা যাওয়ার পর কনস্টেবলের মনে হল ওর পায়ে যেনও কিছু একটা লেগেছে । পায়ের দিকে টর্চটা মারতে কনস্টেবলের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল । কনস্টেবল দেখল ওর পায়ের কাছে একটা মানুষের কাটা হাত পড়ে রয়েছে । তখনই কনস্টেবল নিহার ঘোষ কে ডাক দিল । নিহার ঘোষ ছুটে কনস্টেবল এর কাছে এলো ।
নিহার ঘোষ কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করল , কি হয়েছে ?
তখনই কনস্টেবল নিহার ঘোষ কে সেই মানুষের কাটা হাতটা দেখাল ।
নিহার ঘোষ বিস্মিত কণ্ঠে বলল , মাই গড ! তারপর বলল আশপাশে আরও নিশ্চয় কিছু পাওয়া যাবে ।
অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে নিহার ঘোষ আর কনস্টেবল সামনের দিকে এগিয়ে চললো । খানিকটা যাওয়ার পর নিহার ঘোষ একটা ছিন্নভিন্ন লাশ দেখতে পেলো । লাশটার কাছে যেতেই নিহার ঘোষের যেনও কলজে কেঁপে উঠলো । লাশটার একেবারে বীভৎস অবস্থা । কেউ যেন লাশটার শরীর থেকে মাথাটাকে টেনে হিঁচড়ে উপরে নিয়েছে । পা দুটোকে যেন শরীর থেকে টেনে ছিঁড়ে আলাদা করে দিয়েছে । নিহার ঘোষ দেখল পরে থাকা গাছের শুকনো পাতায় রক্ত লেগে রয়েছে । নিহার ঘোষ লাশটার ধরন দেখে বুঝতে পারল এটা সেই ভয়ানক দানবের কাজ । লাশটাকে দেখার পর কনস্টেবল ওখানেই হড়-হড় করে বমি করে ফেলল ।
নিহার ঘোষ কনস্টেবল কে জিজ্ঞাসা করল , তুমি ঠিক আছো ?
কনস্টেবল বলল , আই অ্যাম ওকে স্যার ।
নিহার ঘোষ বলল , গুড । তুমি মিসেস নন্দিনিকে কে ডেকে নিয়ে এসো । লাশটাকে সনাক্ত করতে হবে । আমার যেটুকু মনে হয় এটা মিসেস নন্দিনির স্বামীর লাশ । যাইহোক তুমি ওনাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো ।
পুলিশের গাড়িতে নন্দিনী আর অর্ক বসেছিল ।
কনস্টেবল এসে নন্দিনীকে বলল , স্যার আপনাকে ডাকছেন । আপনাকে আমার সঙ্গে এক্ষুনি যেতে হবে ।
নন্দিনী বলল , হুম ......... চলুন ।
নিহার ঘোষ ফোনটা নিয়ে দেখছিল । কনস্টেবল এসে স্যার বলে ডাকল । নিহার ঘোষ সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে তাকাল ।
নিহার ঘোষ বলল , আসুন মিসেস নন্দিনী আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ।
নন্দিনী বলল , কি ব্যাপার বলুন তো ?
প্রথমে নিহার ঘোষ কনস্টেবলকে অর্ককে এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্য আদেশ দিল তারপর বলল আমরা একটা লাশ পেয়েছি । আমার সন্দেহ ওটা আপনার স্বামীর লাশ । আপনাকে একবার লাশটা শনাক্ত করতে হবে ।
নন্দিনী লাশটার বীভৎস অবস্থা দেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে রইল । তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে নন্দিনী লাশটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো । লাশটার গলায় থাকা সরু সোনার লকেটটা নন্দিনীর কেমন যেনও চেনা চেনা লাগলো ।
নন্দিনী নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল , এই লকেটটা কোথায় যেনও দেখেছি ।
খানিকক্ষণ চিন্তা করতে করতে নন্দিনীর মনে পরে গেলো ।
তারপর নন্দিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বলল , এটা তো … সৈকতের লকেট ! তার মানে এটা …… !
নন্দিনী মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল আর ওর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল । নন্দিনী হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগলো ।
নিহার ঘোষের বুঝতে আর একটুও অসুবিধা হলো না । তার সন্দেহই ঠিক । এটা সৈকতের লাশ !
সমাপ্ত