মেঘাচ্ছন্ন বিকেল। পাগলা বাতাস সোঁ সোঁ শব্দ করে এদিক সেদিক যদৃচ্ছভাবে বহমান। যেন প্রকৃতির মন খারাপ। এই পরিবেশ'কে সঙ্গী করে ছাদে সুইমিংপুলের পাশে বসে কিছু কথা ভেবে চলেছে সাহির আপনমনে। ভেবে চলেছে বললে ভুল হবে আত্মগত হয়ে দিক বেদিক ভুলে স্মৃতিচারণ করছে। হালকা বাতাসের ঝাপটার সাথে ভেসে আসছে ছাদে থাকা ফুলগাছ গুলোর নানান বাহারি ফুলের সুভাষ। নাসারন্ধ্র দিয়ে সুক্ষ্মভাবে উইন্ড পাইপ পথে ফুসফুসে গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে । ধূসর কালো রঙের মেঘগুলো আকাশে ছোটাছুটি করছে এলোমেলো করে। যেন নিজেদের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে তারা। চারপাশের শহুরে পরিবেশটা অবর্ননীয় মাত্রায় মোহনীয়। যে কাউকেই মূহুর্তে নিজের মোহে বেঁধে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু এসব কিছুই সাহিরের মন, মস্তিষ্ক দু'টোই স্পর্শ করতে অপারগ। এই পরিবেশ, এই ক্ষন যার হাতে হাত রেখে, পাশ ঘেঁষে বসে উপভোগ করার ইচ্ছে ছিল সেই তো নেই তার জীবনে। আর না কখনো তার পাশে থাকবে। সে সম্ভবনাও ক্ষীনকায়। হাতে হাত রেখে দু'জনের কখনো উপভোগ করা হবে না প্রকৃতির এমন অকৃত্রিম নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সে কখনো সাহিরের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির নেশায় মগ্ন হবে না। তাইতো কেবল বাহ্যিকভাবে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে বাতাস কিন্তু মন আর মস্তিষ্ক ছুঁতে বারবারই অপারগ। তার মনে যে কেবল সে মানুষটারই দখল! সবটা জুড়ে সে-ই বিরাজিত।
"শুনুন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি আর সে-ও আমাকে ভালোবাসে। তাই এখন আপনার সাথে আমার বিয়েটা না হলেই আপনার এবং আমার দুজনের জন্যই মঙ্গল। অন্য ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিন প্লিজ, সুখী হবেন। আর আমিও আমার প্রিয় মানুষটার সাথে সুখী হতে চাই। আপনি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকেন তাহলে আমার কষ্ট হোক এমন কাজ কখনো'ই নিশ্চয়ই আপনি করবেন না, না? আপনার আর আমার কখনোই এক হওয়া সম্ভব না। কখনোই না। কারন এর পরিনতি আমাদের দু'জনের জন্য শুভ হবে না। যতটুকু শুনেছি আপানার ব্যাপারে, যথেষ্ট ভালো এবং বোধ সম্পন্ন মানুষ আপনি। আমি সেটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আশা করছি আপনি বুঝবেন। ভালোবাসি না আমি আপনাকে! অন্য কাউকে ভালোবাসি আমি! প্লিজ বিয়েটা ভেঙ্গে দিন! দয়া করুন। নাহলে আমি কিন্তু অন্যকোনো স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।
'এভাবে ঝাঁঝালস্বরে কথা না বললেও পারতে। আমি তোমাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি কি করলে! '
কোনো ভুল করিনি আমি। এইভাবেই বলা উচিত ওনাকে। এবার আমি নিশ্চিত নেমে যাবে মাথা থেকে ভালোবাসার ভূত! বুঝবেন, আমি ভালোবাসি না ওনাকে।"
এই কথাগুলো'ই এই মূহুর্তে সাহিরের মন, মস্তিষ্ক দুটো'ই দখল করে আছে। তাইতো শরীরে হালকা কাপুনি ধরিয়ে দেওয়া বাতাস, মন জুড়ানো ফুলের সুভাষ, আকাশ জুড়ে বিচরনকারী মেঘেদের খেলা কিছুই তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে একেবারেই অসফল। বিগত সাতবছর ধরে এই একটা ফোনালাপই তাকে অসম্ভব রকমের ভাবুক করে তোলে মাঝে মধ্যে। বিশেষ করে একাকী মুহূর্তে। অসহ্যনীয় পরিমাণে যন্ত্রনা দেয় এই স্মৃতিচারণ তাকে। তারপরও সাহিরের ভালোলাগে প্রিয় মানুষটার কথা ভাবতে। মনে প্রশান্তি অনুভব হয়। সেদিনের কথাগুলো কি খেয়া'ই বলেছিল নাকি বুঝতে কোথাও ভুল হয়েছিল সাহিরের! মাঝে মধ্যে মনে হয় সম্পূর্ন ঘটনায় ভুল, হয়তো সাহিরের একবার হলেও যাচাই করা দরকার ছিল সবকিছু সেদিন। উচিত হয়নি সব কিছু এভাবে ছেড়ে ছুড়ে চলে আসা। কিন্তু কিইবা করার ছিল তার! প্রচন্ড অসহায় প্রতিপন্ন হচ্ছিল সে মূহুর্তে নিজেকে সাহিরের। সেদিন ফোনের কন্ঠস্বরটা খেয়ার মতো মনে হয়নি কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছিল খেয়ার বাবা নিজে তো কখনোই ভুল নাম্বার দেবেন না। তিনি নিজেও তো চেয়েছিলেন খেয়া সাহিরের জীবনসঙ্গিনী হোক। ফোনে কথা বলেছে দেখে হয়ত অন্যরকম শুনিয়েছে কন্ঠস্বর। কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পূর্বেও যার গলার আওয়াজ শুনেছে, সে? সাহিরের মনে হয়েছে যেন হুবুহু ওর খেয়ার মিষ্টি কন্ঠস্বর। যেন ওর খেয়া স্বয়ং বলেছে কথাগুলো। কিন্তু মনে উঁকি ঝুঁকি মারছিল অন্য প্রশ্ন, তাহলে কি সে নিজে সাহিরের সাথে কথা বলেনি? অন্য কাউকে দিয়ে বলিয়েছে? কিন্তু কেন? কারন কি সেটায় যা সাহিরের মনের তীক্ষ্ণ বিচারের প্রতিফল। যতই হোক সাহির যে ওর.. ! নিজের ভাবনা আর সামনে এগুতে পারল না সাহির। তার আগেই কেউ 'বাবাই' বলে দৌড়ে এসে পেছন থেকে শক্ত করে ঝাপটে ধরেছে ওকে। এতক্ষণে বিদু্ৎ চমকাতে শুরু করেছে বেশ, বেগ বেড়েছে বহমান বাতাসের, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অনেক চেষ্টা করল সাহির চোখের পানি নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু শেষ অবধি সে অপারগ। অতি সন্তর্পনে চোখের নোনা পানিগুলো'কে বা'হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নেয় সাহির। অতঃপর ডান হাতে বেশ কৌশলের সাথে পেছনে ঝাপটে ধরে রাখা আগন্তুককে সামনে এনে উরুর উপরে বসিয়ে দেয় দক্ষতার সঙ্গে। অতঃপর মুচকি হেসে দুগালে হাত রেখে পরম স্নেহে কপালে চুমু খায় তার কপালে। তারপর কপট অভিমানের ছলে দুষ্টুমি স্বরে করে বলে উঠে,
"নানাবাড়ি গেলে তো কারো বাবাইয়ের কথা মনেই থাকে না, না? তখন বাবাই ফেলনা! "
"নো বাবাই, নো। আই মিসড ইউ সো মাচ! আমি তোমাকে এত্তগুলা মিস করেছি সত্যি।"
তৎক্ষনাৎ সে অগন্তুক শিশু দু'হাত দু'পাশে প্রসারিত করে মিস করার পরিমান দেখায়। সে সঙ্গে মিষ্টি করে হেসে কথাগুলো বলে সে।
হেসে ফেললো সাহির ওর এহেন কান্ডে। দু'হাতে তাকে আরো কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো নিবিড়ভাবে। তারপর হাসি মুখে বলে উঠল,
"তাহলে তোমার আসতে দেরি হলো কেন চ্যাম্পি? আমি অফিস থেকে এসে সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, জানো? "
"নানুমনি আসতে দিচ্ছিলো না তো, কিন্তু আমি মামনি, মাম্মাম আর বাবাকে অনেক বেশি মিস করছিলাম তাই জোড় করে চলে এসেছি। "
"তাই? আমিও মিস করছিলাম সোনা। কিন্তু, তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি এখানে? "
"তোমার গাড়ি দেখেই বুঝেছি তুমি এসেছো, আর আমি না থাকলে তুমি যে এখানেই থাকো আমি জানি সেটা। "
কথা বলার সময় মুখ ভঙ্গিতে মনে হলো সাহিরের শিশুটা যেন বাচ্চা নয় কোনো আশি বছরের বুড়োর। তার সঙ্গেই সাহিরের বর্তমান কথপোকথন চলমান। ছেলেটা এতো কম বসয়ে কিকরে যে এতো পাঁকা। অবশ্য এসব পাঁকা পাঁকা কথা বলেই তো হাসিয়ে রাখে সাহিরকে। ভুলিয়ে দেয় মূহুর্তে সব বিষন্নতা, অতীতের যন্ত্রণা!
বাচ্চাটার কথা শুনে "ওররে আমার চ্যাম্পি!" বলে হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে সাহির। তারপর অতি স্নেহে কপালে চুম খায় আবার। কিছুক্ষণ আগেও মনটা কালো মেঘের প্রভাবে আকাশে যেমন গুমোট ভাব ধরে থাকে তেমন ছিল। কিন্তু এখন নিজেকে তুলোর মতোন হালকা মনে হচ্ছে সাহিরের। আসলেই এই ছেলেটা না থাকলে যে তার কি হতো! সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ওর জন্যে অন্যতম উপহার এই ছেলেটা। ওর জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন! অন্ধকারে একফালি সুক্ষ্ম আলোর রেখা! খেয়াহীন জীবনে সাহিরের নিঃশ্বাসের কারন।
"বাবাই চলো না! কুইকলি প্লিজ! আই ওয়ানা মিট দেম আর্লি আর্লি। আই বেডলি মিস দেম। "
"ওকে চল, তাড়াতাড়ি যাই। আমিও খুব মিস করছি। "
বলেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল সাহির। পেছনে ফেলে নিজের কষ্টগুলোকে, তীব্র যন্ত্রণাগুলোকে। সময়ে অসময়ে মনের কোনে উদ্ভুত প্রশ্নগুলোকে নিজের মনের মধ্যে চাপা দিয়ে। আবারও হয়তো একাকী কোনো মুহূর্তে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এসব প্রশ্নগুলো। আর কষ্ট? সে জিনিসটা তো প্রতি ক্ষনে ক্ষনে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় মনটাকে! নিঃশ্বেস করে দিতে চায় সাহিরকে। যখনই মনে পড়ে প্রিয় মানুষটার কথা তখনই যেন দম আটঁকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কিন্তু নিয়তির ঊর্ধ্বে কেউ নয়। মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয় পরিস্থিতি সাপেক্ষে নিজেদের। সাহিরও করেছে তাই! তবে ভবিষ্যতে কি ঘটবে কি অপেক্ষা করে আছে কেউই অবগত নয় সে সম্মন্ধে! হয়তো অতি ভালো কিছু অপেক্ষায় আছে সাহিরের। যতোটা কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি সুখ! তবে সেই খেয়া নামক মেয়েটাকে ছাড়া আদৌও কি সুখী হবে সাহির? সেও কি ভালো আছে সাহিরকে ছাড়া? সময় সবচেয়ে বড় ঔষধ। সময়ই বলে দেবে কি ঘটবে কার জীবনে!
চলবে....