নাস্তিক
নমস্কার প্রিয় পাঠকেরা। আমি এটা ভেবেই খুব আনন্দ পাচ্ছি যে আপনি আমার গল্পটা পড়ছেন। আমি একজন নামী দামী লেখক নই তবে সবার মত আমি Diary লিখতে খুবই পছন্দ করি। ও! আমি কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি আপনাকে আমার পরিচিতি দিতে। আমার নাম অখিলেন্দ্র মহাপাত্র, সবাই আমাকে অখিল বলে ডাকে।
আমি একটি নামী কোম্পানির ফিল্ড ম্যানেজার হিসাবে কাজ করি। তাই সেই কারণে আমাকে প্রায় বাইরে কাজ করতে যেতে হয়। গত সপ্তাহেই, আমাকে বিহারের কাঠিহারে যেতে হয়েছিল। আমার অবশ্য যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না কারণ বাড়িতে আমার ছেলে অসুস্থ। অবশ্য এই ছেলের অসুস্থতার জন্য আমি অনেকগুলি ছুটি করে ফেলেছিলাম। তাই এইবার না গেলে আমার চাকরি চলে যেত। আমি তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
বিহারে যাওয়ার জন্য ট্রেন ছিল রাত দশটায়। আমি সাতটা থেকেই বাড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, রাত্রিরের ট্রেন ধরার জন্য। বিশাল ট্রাফিক পেরিয়ে আমি ঠিক 9:45 ট্রেশনে পৌঁছালাম। ট্রেনের যে কামরায় উঠলাম সেটা অবশ্য অনেকটা খালি ছিল। গুটি কয়েক প্যাসেঞ্জার ওই কামরায় ছিল। ট্রেন ছাড়ার পরই আমি বাড়িতে ফোন করে আমার বউয়ের ও আমার সন্তানের খবর নিলাম আর জানিয়ে দিলাম যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
কয়েকটি ট্রেশন পর এক ভদ্রলোক আমার কামরায় উঠলেন। তিনি আমার ঠিক উলটো দিকের সিটে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তার বয়স 70 পেরিয়ে গেছে, ছিমছাম চেহারা আর গোটা গাল জুরে সাদা লম্বা দাড়ি। সেই ভদ্রলোক নিজে থেকেই আমার সাথে আলাপ পরিচয় করতে শুরু করলেন আর আমিও তার সবকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলাম।
"আমি একজন নাস্তিক। এখন অবশ্য সেটা সবাই জানে। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে নাস্তিক ছিলাম না"। আমার ভগবানের প্রতি বিশ্বাস আছে কিনা তার উত্তরে আমি ভদ্রলোককে তা জানালাম। ভদ্রলোক আমাকে নাস্তিক হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাকে বললাম যে আমার ছেলে জন্মের পর থেকে থ্যালাসেমিয়া রোগের শিকার। প্রতি মাসে তাকে fresh রক্ত দান করতে হয়। এমনকি আমার wife এর কিছুদিন আগেই একটি ভয়াবহ accident এ পা ভেঙ্গে ঘরে বসে আছে। জীবনের বিভিন্ন সমস্যায় আমি জর্জরিত। আমি বহুবার ভগবানকে ডেকেছিলাম এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করে দিতে। তিনি আমার সমস্যার কথা শুনেননি। তাই আমি তাকে আর শ্রদ্ধা করি না। আমার মুখে সব শুনে ভদ্রলোক বললেন "তবে আমার জীবনের একটা গল্প শোনো"। তিনি বলতে শুরু করলেন।
ছোটবেলায় থেকে ঠাকুরের প্রতি আমার একটি আসক্তি জন্মেছিল। তাই ছোটবেলায় আমি মেলা থেকে বহু দেবদেবীর মূর্তি কিনে পুজা করতাম। তা দেখে লোকেরা আমার বাবাকে ডেকে বলতো "তোমার ছেলেতো মহান আস্তিক হবে"। আমি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে স্নান করে সেই দেব-দেবীকে খাওয়ার দিয়েই স্কুলে যেতাম। এমনকি সন্ধ্যেবেলায় ঘটা করে সন্ধ্যা পূজা দিতাম।
ঠিক আমি যখন কৈশোরে পা দিয়েছি তখনই হঠাৎ আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার মা যেন সুস্থ হয়ে যায় এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি বিভিন্ন মন্দিরে মানত করতে লাগলাম। যেখানেই শুনতাম ভগবানের স্থান, সেখানে গিয়ে আমি হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতাম। আমার বাবা, মায়ের চিকিৎসার জন্য বড় ডাক্তার নিয়োগ করলেন।
সে সময় ইংরেজদের রাজত্ব ছিল। আমার বাবা সেই সময়কার জমিদারের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আমার বাবার মাসিক আয়ও অনেক বেশী ছিল। তাই আমার বাবা এক ইংরেজ ডাক্তারকে আমার মাকে সুস্থ করার দায়িত্ব ভার দেন।
ইংরেজ ডাক্তারটি ঘোর নাস্তিক ছিলেন। তিনি হিন্দু দেবদেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তিনি আমার এই ঠাকুরের প্রতি ভক্তি একেবারেই সহ্য করতে পারলেন না। অবশ্য প্রথমদিকে তিনি কিছুই বলতেন না। তবে মনেপ্রাণে তিনি সেটা মেনে নিতেও পারেননি। পরবর্তীকালে তিনি নানা রকম উপায় অবলম্বন করেছিলন যাতে আমার ঠাকুরের প্রতি ভক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আমাকে বহু রকমের প্রাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বইগুলো উপহার দিতেন যাতে ভগবানের কোন অস্তিত্ব নেই সেই ব্যাপারে প্রমাণসহ রচনা ছিল। আমি অবশ্য বই গুলো মন দিয়ে পড়তাম কিন্তু তবুও আমি ভগবানকে বিশ্বাস করতাম। শেষমেষ আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন না দেখে তিনি আমাকে আর বিপথে চালানোর কোনো রকম চেষ্টাই করতেন না।
আমি যখন জানতে পারলাম আমার মায়ের ক্যান্সার হয়েছে তখন থেকে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতাম যেন আমার মা সুস্থ হয়ে ওঠে। সেই প্রার্থনা ঠাকুর আমার শুনেনি। আমি নিজের চোখে আমার মাকে কষ্ট পেতে এবং মারা যেতে দেখেছিলাম। তবে থেকেই ঠাকুরের প্রতি জন্মালো আমার রাগ আর হয়ে গেলাম নাস্তিক।
নাস্তিক হয়ে অবশ্যই আমি সফল হলাম, ব্যবসা করলাম, বিয়ে করলাম এবং মস্ত বড় একটা গাড়ি কিনলাম। যেহেতু সফলতা আমাকে শীর্ষে পৌঁছে দিচ্ছিল তাই ভগবানের পূজা করাও আমি বন্ধ করে দিলাম। আমার দম্ভ আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্য। আমি আমার বাড়িতে ভগবানের একটা ছবিও রাখলাম না। এমনকি দুর্গাপূজার সময় আমি দুর্গা প্রতিমাও দর্শন করতে যেতাম না। আমার স্ত্রী ও আমার সন্তানকে কোন রকম পূজা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ ছিল। একদিন এক ঘটনা আমাকে আবার আস্তিক হতে বাধ্য করে।
সেদিন আমি আমার মস্ত বড় গাড়ি নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে রাস্তায় বেরিয়ে ছিলাম। একটা ক্রসিংয়ে যখন লাল সিগন্যাল পরল তখন আমি গাড়িটাকে থামাবার চেষ্টা করাতেই বুঝতে পেলাম আমার গাড়ির ব্রেক ফেল করেছে। সামনে এক সরকারি বাস আমার দিকে এগিয়ে আসছিল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম গাড়ির ব্রেক মারার। আমি কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সরকারি বাসটি যতই কাছে এগিয়ে আসছিল আমার মৃত্যুর সম্ভাবনা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তেও আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ভগবানের নাম নেইনি। ওই মুহূর্তে আমার বাঁ দিকের রাস্তার ধারে একটি লম্বা গলি লক্ষ্য করলাম। ভাবলাম কোনমতে আমি যদি গাড়িটাকে নিয়ে ঐ গলিতে থাকা কোন দেওয়ালে ধাক্কা মেরে দিই তো আমি হয়তো বেঁচে যেতে পারি। আমি সেই চেষ্টাই করতে লাগলাম। কিন্তু গাড়িটা যেই গলিতে ঢোকালাম, আমার সামনে আরও একটা বিরাট বিপদের সম্ভাবনা দেখতে পেলাম।
সেই গলিতে সাতখানা নিষ্পাপ বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছিল। আমার ওই ব্রেক ফেল করা গাড়িটা হরহর করে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি এবার বুঝে গেলাম আমার ওই গাড়িটা সাতটা বাচ্চাকেই পিষে মেরে দিতে যাচ্ছে। আমি এবার প্রাণপণ চিৎকার করে তাদের সরে যেতে বললাম। কিন্তু তারা খেলায় এতই মগ্ন ছিল যে তারা আমার চিৎকার শুনতেই পারল না। তাদের অবশ্যাম্ভাবীক মৃত্যুর কথা ভেবে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আমি কাতর স্বরে ভগবানকে ডাকতে শুরু করলাম। "হে ভগবান, হে সর্বশক্তিমান তুমি দয়া করে এই নিষ্পাপ বাচ্চাদের বাঁচাও"।
যেসব বাচ্চারা যারা ক্রিকেট খেলছিল তাদের উইকেটটা ইটের ওপর ইট রেখে বানানো হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, এক বাচ্চা কাউকে আউট করার উদ্দেশ্যে ওই সাজান ইটের তৈরি উইকেটে সজোরে বল ছুড়ে মারল। আর ওর মধ্যে থেকে একটা ইট সোজা এসে পড়ল আমার গাড়ির সামনের চাকায়। এটা হয়তো গাড়ির আশেপাশে দিয়েও বেরিয়ে যেতে পারত কিন্তু ওই ইটতার জন্য আমার সামনের গাড়ির চাকা আটকে পড়ল ও সেই জায়গায় গাড়িটা থেমে গেল। এভাবে সাতখানা নিষ্পাপ বাচ্চাদের প্রাণ বেঁচে গেল।
সেইদিন আমি বুঝতে পারলাম ভগবানের কাছে নিজের জন্য কিছু চাইলে তা পাওয়া যায়না কিন্তু পরের উপকারের জন্য যাহাই চাই ভগবান তা পূরণ করে।
আমি ছোটবেলায় আমার মাকে বাঁচানোর জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য ভগবানকে ডেকেছিলাম কিন্তু ভুলে গেছিলাম জন্ম-মৃত্যূ যে যার ভাগ্যে আগে থাকতেই লেখা থাকে। আমি ভগবানের আসল তথ্য বুঝলাম এবং আমার নাস্তিকতা ঘুচে গেল। আমি সত্যিকারের জানতে পারলাম ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্য।
আমিও যেন তার গল্প শুনে ভগবানের মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানলাম। আমি কিছু বলার আগেই আমার কেমন যেন টয়লেটের জন্য পেটে ব্যথা শুরু করলো। আমি চাপার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আমি তাই তড়িঘড়ি ট্রেনের বাথরুমে toilet করতে গেলাম। যখন ফিরে আসলাম, আমি আমার উল্টো দিকের সিটে সেই ভদ্রলোককে আর দেখতে পেলাম না। আমি বাকি যাত্রীদের, ভদ্রলোকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে তারা যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা সবাই জানালো যে এরকম কোন ভদ্রলোককে তারা দেখেননি। আমার বুঝতে বাকী রইল না যে, আমি স্বয়ং ভগবানকে দেখলাম।