একটা দশ বারো বছরের বাচ্ছা মেয়ে শুধুমাত্র একটা ফ্রক পড়া অবস্থায় দরজা খুলে দিল। আমাদের কথা শুনে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে বুঝলাম, আমি এইমাত্র বাইরের পাঁচিলের মধ্যে উঠোনে এসে পৌঁচেছি। বাড়িটি একটি মাটির দোতলা বাড়ি। সামনের বারান্দা এবং উঠোনের চারপাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে বারান্দায় পাঁচ ছয় জন বসে বসে গল্প করতে করতে শুকনো খেজুর পাতা দিয়ে চাটাই বুনছে।
তাদের কাছ থেকে সব কিছু জেনে নিয়ে, আবার বাঁধে উঠে পরি। এবারেই বাঁধের ফৈদরপাড়া শুরু হবে। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে, এই, তোমরা কারা? এখানে কি করতে এয়েচো?
দেখি লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে, হাতে একটা দেশি মদের বোতল নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে। তার কোমরে একটা গামছা বাঁধা আছে। তার চোখ দুটো টকটকে লাল, চুল উস্কো-খুস্কো, জট পরে আছে। মুখে এলোমেলো কাঁচাপাকা দাড়ি।
তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে, হঠাৎ বাঁধের উপর একটা কাঠি দিয়ে দাগ টেনে বলে, এই লক্ষণরেখা টেনে দিলুম। এটিকে পার করেছ কি শেষ করে ফেলবো।
একথা বলার সময়, তার মুখ দিয়ে থুতু ছিটকে পড়ছিল।
আমি আস্তে আস্তে কুন্তলবাবুকে সরিয়ে দিয়ে, তাকে বলি, দেখো আমরা লোকগণনার কাজ করতে এসেছি।
তোমাদের কাছে অশোক চিহ্ন আছে?
বুঝতে না পেরে কুন্তলবাবুর দিকে তাকাই। কুন্তলবাবু সঙ্গে সঙ্গে সমাধান করে ফেললেন। আমাকে সেনশাসের গাইড বইটি বের করতে বললেন। আমি বের করলে, কুন্তলবাবু মাতালটিকে অশোকচক্র দেখালেন এবং বললেন, দেখো আমরা সরকারি লোক। আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে, কাজ করতে না দিলে, আমরা চলে যাব। কিন্তু পরে পুলিশ এসে তোমাদের সকলকে তুলে নিয়ে যাবে, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার জন্য। তোমরা কি তাই চাও? আমরা তো তোমাদের ভালোর জন্যই এসেছি।
আমাকে পুলিশ দেখাচ্চো! জানো, আমার নাম কি? ওসব পুলিশ টুলিশ অন্য কাউকে দেখাবে। বুলেট পুলিশকে ভয় পায় না।
আমিও কুন্তলবাবুকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে বলি। শেষে বুলেটকে পাশ কাটিয়েই আমরা এগিয়ে চলি। এখানেও বাঁধের উপরে কোন ঘরবাড়ি নেই। তবে বেশ কয়েকটি জায়গায় দলে দলে বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা বসে আছে দেখেছি। আবার বাঁধের উপর বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। এখানে বাঁধের দুপাশেই অনেকগুলি বাড়ি রয়েছে। একটা ইটের গাঁথুনির পাকাবাড়িও দেখলাম। এখানে সব বাড়িতে শুধু মেয়েরা আছে দেখছি। আস্তে আস্তে সব তথ্য লিখে রাখতে রাখতে এগিয়ে চলেছি। মাঝে একটা ঝুপড়িতে একটা ঠাকুমা থাকে। যার অনেক তথ্য পেলেও ঠাকুমার নাম জানতে পারলাম না, ঠাকুমাকেও পেলাম না। উনি শুধু সকলের ঠাকুমা।
মোটামুটি দেড়টার দিকে থামলাম। আরও কয়েকটি ঘর বাকি থেকে যাচ্ছে। পরে একদিন আসতে হবে। আজ আর ভালো লাগছে না। আজকে হয়তো বেশি ফর্মের কাজ হয়নি। কিন্তু মোটামুটি প্রায় সারে তিনশোর মতো ঘর সম্পর্কে তথ্য লিখেছি।
কুন্তলবাবুও বললেন তাই চলো। আমরা নিজেরাই ঠিক করে নিই, আগামীকাল সোমবার, আর স্কুল থেকে বেরোব না, সারাদিন স্কুলেই থাকব। মঙ্গলবার টিফিনের পরে একবার বেড়িয়ে বাকিগুলি শেষ করে ফেলব।
সেই মতো সোমবার সারাদিন স্কুলে কাটিয়ে, স্কুল ছুটির পর বিপিনদের বাড়ির দিকে চলি। আজকে আকাশ পরিষ্কার। হালকা বাতাসও বইছে। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি। একটা জায়গায় কতকগুলি বাচ্ছাছেলে বল খেলছে। কাছে আসতে দেখি, কিছু কাগজ ও প্লাস্টিকের প্যাকেট বেঁধে বল তৈরি হয়েছে। প্রয়োজনই এদের বুদ্ধি জুগিয়েছে দেখে ভালো লাগল।
মঙ্গলবার টিফিনের পর বেড়িয়ে সবগুলি বাড়ি ঘোরা সারা হল। প্রতি বাড়ির জন্য ফর্মে সই করানো শেষ হয়েছে। শুধুমাত্র রিং বাঁধে সেই সবার ঠাকুমার ফর্ম বাকি আছে। চারপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও, ঠাকুমার নাম এখনও উদ্ধার হয়নি।
পরে একদিন এসে না হয় ঠাকুমার ফর্মটা পূরণ করে নেব। কুন্তলবাবুও খুব খুশি। সব কাজ হয়ে গেছে।
আজকে ছাব্বিশ তারিখ। আজও ঠাকুমাকে খুঁজতে বেরিয়েছি। সবাই বলে, ঠাকুমা প্রতিদিন সকালে ভিক্ষা করতে বেড়িয়ে যায়, আর বিকেলে ফেরে। তাই স্কুল ছুটির পর ঠাকুমার বাড়িতে যাব ঠিক করেছি। সেইমতো স্কুল থেকে বেরোতে যাব, এমন সময় কুন্তলবাবুও যাবেন বললেন।
আমি আর কুন্তলবাবু সাইকেলে চেপে রিং বাঁধে উপস্থিত হলাম। পাশেই বাড়ি, এমন একজন বললেন, আজ দুপুরে ঠাকুমাকে কল থেকে জল খেতে দেখেছেন। তবে তার পর থেকে আর দেখেননি। কুন্তলবাবুকে নিয়ে ঠাকুমার ঘরের সামনে অপেক্ষা করতে থাকি।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেকেই আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। নানান কথাবার্তাও চলতে থাকে। আমাদেরও সুবিধা হয়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে কার আর ভালো লাগে! প্রায় ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে আছি। জানি না, আর কতক্ষণ পর ঠাকুমা ফিরবেন! সারাদিন ভিক্ষা করে কি করেন? ঠাকুমা তো একাই!
দূর থেকে দেখতে পাই, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কলাইয়ের থালায় কিছু একটা খাচ্ছেন। কিন্তু কি খাচ্ছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। যখন থালায় হাত দিচ্ছেন, তখন খাদ্যবস্তু সাদা হয়ে যাচ্ছে। আবার থালা থেকে হাত উঠিয়ে নিলেই, কালো মতো কিছু একটা থালায় আছে। ঠিকমতো বুঝতে না পেরে, কুন্তলবাবুকে দেখাই।
দেখি কুন্তলবাবুরও, আমারই মতো অবস্থা। কি খাচ্ছেন উনি? কেনই বা বারেবারে খাদ্যবস্তু রং পাল্টায়? নাকি আমরা ভুল দেখছি! হাতে কোন কাজ না থাকায়, রহস্য উন্মোচন করতে এগিয়ে যাই।
যা দেখছি, তা না দেখলেই বোধ হয় ভালো হতো। ভদ্রলোক সারা দিনের শেষে, জলে ভিজিয়ে খানিকটা মুড়ি খাচ্ছেন। কিন্তু এখানে শুধুমাত্র তিনিই সারাদিন উপোস ছিলেন, তাই নয়, অনেকগুলি ছোট ছোট জীব, যাদের আমরা মাছি নামে চিনি, তারাও তো সারাদিন কোন খাদ্য পায়নি। তাই তারাও ছুটে এসেছে। আর সময়ও তো বেশি নেই। যতটা পার খেয়ে নাও। শুধু হাতটি যখন নামছে, তখন সরে গেলেই হল।
মনের মধ্যে একটা সংশয় দেখা দেয়। কিভাবে থাকে এরা! এদের তো যে কোন সময় অসুখ বিসুখ হতে পারে। কিন্তু কি আর করা যাবে! আমাদের ক্ষমতাই বা কতটুকু! এমন সময় দেখি, ঠাকুমার ঘরের সামনের প্লাস্টিকের পর্দাটা যেন একটু নড়ে উঠল। দেখি ভিতর থেকেই পর্দাটা কেউ যেন সরাচ্ছেন। হ্যাঁ, ঠিকই দেখছি, ভিতর থেকে ঠাকুমা বেড়িয়ে আসছেন।
ঠাকুমা তাহলে ঘরের মধ্যেই ছিলেন। আমরাই বড় বোকা! তাই তো এই জায়গাটিই আজকে খোঁজা হয়নি। অথচ সবার আগে এখানেই খোঁজা উচিত ছিল।
ঠাকুমা, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
কেন বাবা?
তোমাকে একবার বলেছিলাম না, আমরা লোকগণনার জন্য এসেছি।
তাহলে গুণে নাও। আমি একাই থাকি। কিছু ভিক্ষে পেলে খাই, না পেলে সেদিন শুধু জল খেয়েই কাটিয়ে দিতে হয়।
আজকে ভিক্ষা করতে বেড়োওনি?
হ্যাঁ, বেড়িয়েছিলাম তো। সকালে বেড়িয়েছিলাম। দুপুর পর্যন্ত ভিক্ষে করে দুটাকা পঁয়ষট্টি পয়সা পেয়েছি। তাই দুপুরে জল খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই পয়সাটা নিয়ে এখন দোকানে গিয়ে কিছু মুড়ি কিনে নিয়ে আসি। হোদলের মেয়েটাও সারাদিন কিছু খায়নি।
ঠাকুমা হোদল কে?
ওই যে ওই ঘরটা হোদলের। ওখানে গুণতে যাওনি? তোমরা তো বাবু সরকারি লোক। একটু দেখো না। হোদলটা সেই যে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে শয্যা নিল, তারপর থেকে তো আর উঠতেই পারে না। শুনেচি, পায়ে নাকি পাত বসাতে হবে। অনেক টাকা লাগবে কে দেবে অত টাকা!
বুঝতে পারি না, হোদলের সাথে ঠাকুমার পারিবারিক সম্পর্ক কি। তাই জিজ্ঞাসা করি, হোদল তোমার কে হয়?
আমাকে তো এ পাড়ার সবাই ঠাকুমা বলে, হোদলও বলে।
ঠাকুমা, এবারে যে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর বলে দিতে হবে।
কি করে বলি বল দেখি। আমি তো আর কোন দিন ইসকুলেও যাইনি।
না গো ঠাকুমা, আমি খুব সহজ প্রশ্নই করবো।
আচ্ছা নাও। বল।
তোমার নাম কি?
আমাকে তো সবাই ঠাকুমা বলে। তোমার নাম তো একটা ছিল। সেটা বল।
সবাই ছোটবউ বলে ডাকতো। আর তোমার বাবা মা কি বলে ডাকতো?
আমার তো বাবা মা নেই বাবু। কবেই মরে ভুত হয়ে গেছে। যখন বেঁচেছিল, তখন কি বলতো?
সে তো অনেক দিন আগের কথা। ওসব আর মনে নেই।
আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে। কি নাম লিখবো! হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ঠাকুমা, তোমার ভাটার কার্ড আছে?
ছিল একটা। কিন্তু কার কাছে আছে, ঠিক মনে নেই। যখন ভোট আসে, তখন কেউ না কেউ এসে ভোট দিতে নিয়ে যায়। আর সেদিন আমার খাওয়াটাও বেশ ভালো হয়।
কিন্তু আমি এখন কিভাবে উদ্ধার করবো, কিছুতেই বুঝতে পারিনা। তবুও প্রশ্ন করতেই থাকি। আচ্ছা ঠাকুমা, তোমার কোন ছেলেমেয়ে নেই?
না রে বাবা, আমার দুটো মেয়ে ছিল। কোন রকমে তাদের বিয়েথা দিয়েছিলুম। বড় মেয়েও অনেক দিন আগেই চলে গেছে।
তোমার রিং বাঁধে কে আছে তাহলে?
ওই যে হোদল। আসলে আমি ওর দিদা হই। কিন্তু সবাই ঠাকুমা বলে, হোদলও বলে।
বুঝতে পারি, উনি ছোট মেয়ের বাড়িতে আছেন। তোমার ছোট মেয়ে কোথায় আছে?
কোথায় আর থাকবে বাবা! মায়ের কাছে মেয়ে সর্বদা বুকেই থাকে। বাপমরা মেয়েটাকে, বুকে আগলে রেখে মানুষ করেছিলুম। বড় ঘর দেখে বিয়ে দিলুম। ভগবানের সহ্য হলুনি। সাপে কেটে বরটাকে তুলে নিলে। মেয়েও আমার কাছে হোদলকে রেখে সতী হলো। সেই থেকে এখানেই আছি। সবাই তখনও ঠাকুমা বলতো, এখনও বলে।
কিন্তু হোদল নামে তো কোন ফর্ম আমি পূরণ করাইনি। তবে কি ঠাকুমার সাথে হোদলও বাদ চলে গেছে! যাইহোক, আজ আমি শেষ করবোই। ঠাকুমাকে তো পেয়েছি। আচ্ছা ঠাকুমা, তোমার শ্বশুর বাড়ি কোথায়, মনে আছে?
বর্ধমানে। এখান থেকে অনেক দূর। সকালে বাসে চাপলে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যেত।
সেখানে যাও?
কে আছে সেখানে, যে সেখানে যাব?
সেখানে তোমার যে ঘরদোর ছিল, কারা থাকে সেখানে?
আমি তো ছোটবউ। বড়বোয়ের ছেলেপুলেরা থাকে।
তারা তোমাকে মা বলে না?
এই দেখো, কাকিকে মা বলবে কেন?
শেষ কবে সেখানে গিয়েছিলে?
যখন হোদলের বাপ মরলো, তার আগে তো বর্ধমানেই ছিলুম। কিন্তু সেই যে এলুম, আর ফেরা হল না। সব হারিয়ে শুধু হোদলকে বুকে আগলে রেখেছিলুম। কেউ দেখেনি বাবা, সেদিন থেকেই বুঝে যাই, হোদলকে বাঁচাতে গেলে, ভিক্ষে করেই খাবার জোগাড় করতে হবে। আর আমি মরে গেলে দশমাসের বাচ্চাকে কে দেখবে। এসব জেনে কি হবে বাবু? এই তো হোদল পা ভেঙে এক বছর পরে আছে। ওর বউকে নিয়ে হাসপাতালে গেছিলুম। দিন পনেরো মতো রেখেছিল। তারপর পয়সা জোগাড় হয়নি বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। বউটা এদিক ওদিক থেকে চেয়ে চিন্তে চেষ্টা চালাতে চালাতে নিশীথ বেরাদের বাড়ি কাজে লেগেছে। একবেলা খেতে পায়। তাই নিয়ে এসে তিনজনে খায়।
নিশীথ বেরা আবার কে?
এই দেখো, রিং বাঁধে এয়োছ, আর নিশীথ বেরাকে চেনো না! (দূরে একটা পাকাবাড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে) ওই যে বাড়িটা দেখছো, ওটাই নিশীথ বেরার বাড়ি। রিং বাঁধে একমাত্র ওদেরই নিজের ভিটেবাড়ি আছে। বাকি সবাই তো সরকারি বাঁধের জেগায় আছে। ওদের বাড়িই বউ কাজ করে। ওরা খুব ভালো লোক গো। অনেকটা করেই ভাত দেয়।
ঠাকুমা, তোমার বাপের বাড়ির কথা মনে পরে? এদিকে আমার কোন উত্তরই জানা হচ্ছে না। কি সব প্রশ্ন করছি! কিন্তু কিভাবে জানব, ঠাকুমার নাম কি।
আগে পড়তো।
তোমার কোন ভাইবোন নেই?
আমি সবার ছোট গো। বাপের বাড়িতেও ছোট ছিলুম, শ্বশুর বাড়িতেও ছোট।
তোমার দাদা দিদিরা তোমাকে কি বলে ডাকতো?
ছোট।
(এ আবার কি নাম! 'ছোট' আবার কারোর নাম হয় নাকি! আর পদবিই বা কি হবে!) তোমার কোন ভালো নাম ছিল না?
কি যেন একটা ছিল।
আমি আশার আলো দেখতে পাই। তাই বলি, একটু চেষ্টা করে দেখো না ঠাকুমা।
বিয়ের আগে সবাই ছোটই বলতো। আর পরে বলতো ছোটবউ।
আর একটু চেষ্টা করোনা ঠাকুমা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পরেছে। আমার দিদির নাম ছিল সুখী, আর আমার নাম ছিল দুখি।
নামের সাথে যে তোমার সবটা মিলে গেছে, বুঝতে বাকি থাকে না। দেখি কুন্তলবাবু এগিয়ে এসেছেন। ঠাকুমাকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলে, ঠাকুমা কিছু কিনে খেয়ো।
হ্যাঁ রে বাবা, ঠকাচ্ছিস না তো! সত্যিই আমায় দশ টাকা দিবি?
প্রায় ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নেয়। ময়লা কাপড়ের খুঁটটা বের করে, তাতে বেঁধে রাখে। বলে, টাকাটা বউকে দিয়ে দেব। তাহলে কালকে হোদলের বাচ্চাটা কিছু ভালোমন্দ খেতে পাবে। জানিস বাবা, আজ পর্যন্ত হোদল, এতো বড় হয়ে গেল, কিন্তু কোন দিন ভালো কিছু কিনে দিতে পারিনি। সবার থেকে চেয়ে চিন্তে পুরোনো ছেঁড়া প্যান-জামা নিয়ে এসে পড়িয়েছি।
ঠাকুমা, তোমার শ্বশুর বাড়িতে পদবি কি ছিল?
ওরা বাগদী ছিল।
এ তো আরও একটা সমস্যা। তবে কি ঠাকুমার নাম দুখি বাগদী? কিন্তু বাগদী তো জাতি, পদবি না।
ঠাকুমা, তোমার বরের নাম কি ছিল গো?
কি যে বলিস তোরা। এই জন্যই তোরা আজকালকার ছেলে! লেখাপড়া শিখেও তোদের এই বুদ্ধি হয়নি, যে গুরুজনদের নাম ধরতে নেই। কি হবে তালে, পড়াশোনা শিখে?
বুঝতে পারি, এই ফর্ম পূরণ করা বোধ হয় আমার কর্ম নয়! কিন্তু করতে যে হবেই।
ঠাকুমা, তোমার বাবার নাম কি?
বাবাকে সবাই শিবু বলে ডাকতো।
শিবু কি?
কি আবার! বাগদী। শিবু বাগদী।
তোমার শ্বশুর বাড়িও তো বাগদী?
হ্যাঁ, বাগদীদের সঙ্গে তো বাগদীদেরই বিয়ে হয়। আমিই শুধু বড় ঘরে ছোটমেয়ের বিয়ে দিয়েছিলুম। সইলো না। বরটাকেই কেড়ে নিলে।
ঠাকুমা, হোদল কোথায় গো?
হোদল তো হোদলের ঘরেই পরে আছে। এসো, নিয়ে যাচ্ছি। দাঁড়া বাবা একটু, লাঠিটা নিয়ে নিই। ভালো করে চলতেও পারি না।
আমি ঠাকুমাকে ধরলে, ঠাকুমা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে। আমিও সামনের দিকে একটা ঘরের সামনে নিয়ে যাই। ঠাকুমাই বাইরে থেকে দরজা খোলে।
এসো বাবারা, এটাই হোদলের ঘর। বউ আচিস র্যা।
দেখি একটা বউ মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে একটা লণ্ঠনের শিখা বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু শিখাটি বেশি আলো দেবার বদলে বেশি কালি ফেলতে লাগলো। বউটিকে দেখে বুঝতে পারি, এই বাড়িতে ঘুরে গিয়েছি। হোদলের ভালো নাম নকুল ফৈদর।
বউটি এগিয়ে এসে বলে, এইমাত্র ফিরলুম ঠাকুমা। খেতে দিচ্ছিলুম। কিন্তু তোমাদের যে কোথা বসতে দিই।
থাক থাক বউদি। আমরা বসব না। শুধু কটি প্রশ্ন করেই চলে যাব। তোমাদের বাড়ি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঠাকুমার এখনো নামই জানতে পারিনি।
লিখে নাও, বলে দিচ্ছি। কে যে নাম রেখেছিল, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। ঠাকুমার নাম দুঃখি পরামানিক।
একটু আগে ঠাকুমাই বলল, দুঃখি বাগদী!
হ্যাঁ গো, ওরা মেছো বাগদী।
আর ঠাকুমার বাবার নাম?
কি একটা যেন শুনেছিলাম।
শিবপদ?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শিবপদ নয়, শিবু পরামানিক।
আর ঠাকুমার বরের নাম? মানে, তোমার স্বামীর দাদুর নাম?
বর্ধমানে বাড়ি জানি। কিন্তু নাম তো জানি না।
এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে ভাঙা গলায় একজন বলে, আমার দাদুর নাম নিতাই পরামানিক।
বুঝতে পারি, হোদলই বলছে। বর্ধমানে কোথায় বাড়ি?
রায়না ব্লক জানি। ওইটুকুই। কোন দিন যাইনি। সেখানে কেউ আছে কিনা, তাও জানি না। একবার যাব যাব করে, আরামবাগ অবধি গেছিলুম। তারপর পকেটে পয়সা শেষ হয়ে যায়। বাস থেকে নামিয়ে দিল। আর যাওয়া হয়নি।
অনেকটাই জানা হয়েছে। এবার ঠাকুমার বয়স কত? দেখে তো মনে হয় অনেকই হবে।
হোদলই বলে, আমারই তো তিরিশ হয়ে গেল। এবারে ঠাকুমার বয়স হিসাব করে নাও। ঠাকুমা আসলে আমার মায়ের মা।
ঠাকুমা তোমার ছোট মেয়েকে কোন বয়সে বিয়ে দিয়েছিলে গো?
অনেক বড় অবধি বুকে করে আগলে রেখেছিলুম রে মেয়েটাকে।
কুন্তলবাবু বলে, কুড়ি কুড়ি চল্লিশ, আরও ত্রিশ, মানে সত্তর হবে। কিন্তু দেখে আরও বেশি বলে মনে হচ্ছে।
ঠাকুমা তোমার কত বয়স হবে গো?
কত আর হবে, চার কুড়ি মতো হবে।
এদিকে হিসাব মিলছেনা যে। তাই হোদলকে জিজ্ঞাসা করি, তোমার কতদিন বিয়ে হয়েছে?
দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। ও ওর বয়স ভুল বলেছে। ওর এখন আটতিরিশ বছর বয়স। হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছিল। তাও এক বছর আগে।
বুঝে যাই, ঠাকুমার তাহলে আশি বছর বয়স। মোটামুটি আর কোথাও অসুবিধা হয়নি। হোদলের কাছে গিয়ে ওকে কিছু একটা করার আশ্বাস দিয়ে আসি।
বউদিকে দিয়েই সই করিয়ে নিই। ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। কুন্তলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে, সাইকেল থাকা সত্ত্বেও হেঁটে হেঁটেই চলতে থাকি। আজকের একটা ঘটনা মনের মধ্যে এমনভাবে আটকে গেল, মনে হয় সারা জীবনেও আর ভুলতে পারব না। ঠাকুমা সারাদিন ভিক্ষা করে মাত্র দু'টাকা পঁয়ষট্টি পয়সা পেয়েছেন। এখানে সে'ই সবথেকে বেশি বড়লোক, যে কিনা একবেলা খাবার দিয়ে আর একজনকে কাজে রাখে। যে নিজের বাড়িতে থাকে। সব ঘটনাগুলো মাথাটাকে যেন ভারী করে রেখেছে। একটা সিগারেট বের করি। কুন্তলবাবুও নেন।
আঠাশ তারিখ বিকাল চারটের সময় সমস্ত ফর্ম ও ম্যাপ একটা নির্দিষ্ট প্যাকেটে পুরে জমা দিলাম। ওখান থেকে বেড়িয়েই সোজা বিডিও সাহেবের ঘরে ঢুকি। আমার সাথে কুন্তলবাবুও আছেন। তাঁকে হোদলের পুরো ব্যাপারটা জানাই। এক বছর পা ভেঙে বাড়িতে পড়ে আছে, এটা জানতেও ভুলি না।
বিডিও সাহেবও ব্যাপারটাকে দেখবেন জানালেন। পাঁচ তারিখ সেনশাসের কাজ মিটে গেলে তবেই দেখবেন। আমরাও বাড়ি ফিরে আসি।
এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই স্কুল চলছে। টিফিনের সময়, হঠাৎ কুন্তলবাবু ডাকলেন। বললেন, একটা সুখবর আছে। আর একটা দুঃখের খবর আছে। কোনটা আগে শুনবে?
যেটা খুশি। আপনি যেটা আগে শোনাবেন।
একটু আগে বিডিও সাহেব ফোন করেছিলেন। হোদলের পা যাতে সুস্থ হয়ে যায়, তার সমস্ত খরচ বিডিও সাহেব ব্যবস্থা করবেন।
খুব ভালো খবর স্যার, ওরা জানে?
না, এখনও জানেনা। তুমিই একবার জানিয়ে দিও।
আচ্ছা স্যার, স্কুল থেকে বেড়িয়ে জানিয়ে আসবো। আর একটা কি খবর স্যার?
হোদলের দিদিমা মারা গেছেন।
সারা জীবনটা দুঃখ পেয়ে পেয়েই গেল। শেষে মারা যাবার সময়, সুখের খবরটা জেনে যেতেও পারল না। যাইহোক, স্যার আমি বরং হোদলকে ব্যাপারটা জানিয়ে আসি।
চলো, আমিও যাই।