Twenty five paisa - 2 in Bengali Fiction Stories by Kalyan Ashis Sinha books and stories PDF | দুটাকা পঁয়ষট্টি পয়সা - 2

Featured Books
Categories
Share

দুটাকা পঁয়ষট্টি পয়সা - 2

রাতে বিপিনদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার পর, আমি আর শান্তনু বেড়িয়ে পরি। রঘুদাকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিতে বলি। এই এতো বড় বাড়িতে রঘুদা আজ একা থাকবে! আমার তো ভেবেই কেমন হয়। যে ঘরে রঘুদা থাকে, সেখান থেকে চেঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। শুধুমাত্র জন্ম থেকেই এখানে আছে বলে রঘুদার কোন অসুবিধা হয় না। বাইরে বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে। অন্ধকারেও ঝড়ের দাপট বোঝানোর জন্য অনেক নিদর্শন দেখতে পেলাম।

একটা মাঝারি আকারের জামরুল গাছ তো রাস্তার উপরেই ভেঙে পড়ে আছে। কোন রকমে পাশ কাটিয়ে পেড়িয়ে এলাম। এবারে শান্তনুকে শুভরাত্রি জানিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

চাবি খুলে বাড়িতে ঢুকে সুইচ অন করে দেখি লোডশেডিং। মানে, আজ রাতে আর এল না! ঝড়ে কোথাও হয়তো তার ছিঁড়ে গেছে। কাল দিনের বেলায় গাছ কেটে সরানোর পর তার জোড়া হবে। কালকে কারেন্ট আসতে পারে আবার নাও পারে। যাইহোক, ভেবে তো কিছু লাভ নেই। গ্রামে থাকবে আর লোডশেডিং হবে না, তা কি করে হয়! তবে আজকে মনে হয়, খুব একটা অসুবিধা হবে না। পোশাক পরিবর্তন করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বেশ খানিকটা জল খেয়ে, শুয়ে পড়লাম। অন্ধকারে তো আর কোন কাজ করা যায় না!

পরদিন সকালে সমস্ত কাগজপত্র ও ফর্ম সঙ্গে নিয়ে রিং বাঁধের উদ্দেশ্যে চললাম। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। কিন্তু যত অগ্রসর হই, দেখি জুতার নিচে কাদা জমে পা ভারি হয়ে আসে। একটু এগোই আর জুতো থেকে কাদা ছাড়াতে চেষ্টা করি। দেখি একজন বয়স্ক মহিলা একটা ছেঁড়া ময়লা কাপড় পড়ে কাদার উপর দিয়ে, একটা বাঁকা গাছের ডাল সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছে।

আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, বাবু জুতো খুলে, খালি পায়ে হাঁটো। না হলে এই পথে যেতে পারবে না। তা কোথা যাবে বাবু?

রিং বাঁধে যাব।

তুমি তো বাবু আজকে ওখানে যেতে পারবে না। গতরাতের বৃষ্টিতে যা কাদা হয়েছে, তাতে বাঁধে ওঠার আগেই পড়ে যাবে। বরং যদি যেতেই হয়, তবে বেরাপাড়া দিয়ে ঘুরে যাও। কাদা কম পাবে। তা তুমি রিং বাঁধে কাদের ঘরে যাবে বাবু?

আমি সবার বাড়িতেই যাব। আর প্রত্যেকের নাম, তাদের বয়স, কে কি করে জেনে আসব।

ও!

তা ঠাকুমা, আপনি কোথায় থাকেন?

আমি তো ভিক্ষে করি বাবু। যেথা রাত হয়, সেথাই থেকে যাই। আচ্ছা, সরকার লোক গুনে কি করবে গো? তিরপল দেবে?

না, না, কিছু দেবে না। প্রত্যেক দশ বছর ছাড়া ছাড়া গোণা হয়। কোথায় কি খরচ হবে, কোথায় রাস্তা ঘাট করতে হবে, তবেই তো সরকার জানতে পারবে।

পেরেই কি হবে? এই তো গেল বছর, দুজন এসে তুলে নিয়ে গেল। বলল, ভোট এয়েচে। ভোট দিলে তবেই রেশন দেবে। তা গিয়ে ভোট দিয়ে এলুম। আর হোদল এসে কার্ডটা নিয়ে চলে গেল। আমি ভিক্ষে করলে, তবেই খেতে পাব। সরকার থেকে লোক গুণতে এয়েচে!

বলতে বলতে ঠাকুমা আমাকে ছেড়ে সোজা চলে গেল। আমি এক জায়গায় স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ঠাকুমার চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। বয়স দেখে মনে হয় আশি পেরিয়ে যাবে। হয়তো ছেলেপুলেরা খেতে দেয় না। তাই বুড়ো বয়সে ভিক্ষা করে পেট ভরাতে হয়। আর কি মজার কথা! জনগণনার নিরিখে ভিক্ষাবৃত্তিও কারোর পেশা হতে পারে। যা মোটে কদিন আগেই শিখেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করি। সিগারেট টানতে টানতেই ঠিক করে ফেলি, এরপর আমি কি করবো।

প্যান্টটাকে কয়েকটা ফোল্ড করে গুটিয়ে নিই। জুতোটা বাঁ হাতে নিয়ে, খালি পায়ে পিঠে লোকগণনার ব্যাগ নিয়ে কাদার মধ্যে হাঁটতে থাকি। আর একটু এগোলেই রিং বাঁধ। এখানে কালীমন্দিরের সামনে লালমাটি দেওয়ার জন্য কাদা নেই। আমি মন্দিরের বাইরে একপাশে কাদামাখা জুতোটা রেখে দিই। হাতে করে নিয়ে ঘোরার থেকে, এখানে রেখে যাই। আবার এই পথেই তো ফিরতে হবে। তখন নিয়ে যাব। এদিকে আটটা বেজে গেছে। অথচ কুন্তলবাবু এখনও এলেন না। তাঁর তো সময়ের নড়চড় হয় না। ওই তো, একেবারে আমারই মতো খালিপায়ে। তবে বাঁ হাতে একটা লাঠি রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করি, লাঠি কি হবে!

ওই কাদার মধ্যে, লাঠি না থাকলে পড়ে যাব। একে একটা হাত ভাঙা, তার উপর পড়ে গিয়ে পা ভাঙলে কি হবে!

স্যার, এটা একেবারে সত্যি কথা। আপনাকে আজকে আর ওই কাদার মধ্যে যেতে হবে না। আমি ঠিক করে নেব। আর একটু পরেই তো প্রশান্তবাবু চলে আসবেন। আপনি আজকে বরং বাড়ি চলে যান।

এই, তা কি করে হয়!

স্যার, আমি তো করছিই। আর কাদার মধ্যে ভাঙা হাত নিয়ে, গিয়েই কি করবেন? তার চেয়ে বরং আমি করে নিচ্ছি। আজ দুপুর পর্যন্ত যতটা হয় করে বাড়ি চলে আসবো। কাল স্কুলে গিয়ে দেখা করে, কতটা হল আপনাকে জানাব।

তাহলে আমি এখন আসি, কোন অসুবিধা হলে ফিরে আসবে।

স্যারকে বিদায় জানিয়ে, আমিও কাদার মধ্যে অগ্রসর হই। কালীমন্দিরের পিছনে শ্মশান থাকার জন্য বোধ হয়, রিং বাঁধের এই অংশটায় কোন বাড়িঘর নেই। তবে দুটো তিনটে খড়ের গাদা রয়েছে। গতকালের ঝড়, তাদের অবস্থা খারাপ করে দিলেও, ভেঙে উড়িয়ে দিতে পারেনি। আমি কাদার উপর দিয়েই হাঁটতে থাকি। বেশিক্ষণ হাঁটতে হয় না। ওই যে লাইন দিয়ে বাড়ি চোখে পড়ছে। আবার এগুলোর কোনটিকেই ঠিক বাড়ি বলা যায় না। বরং ঝুপড়ি বলাই ভালো। কোন কোনটি আবার বাঁধ থেকে মোটে এক দের হাত সমান উঁচু।

যাইহোক, প্রথম বাড়িটি থেকেই শুরু করি। বাড়িতে কেউ নেই। সামনে একটি গরু বাঁধা আছে। দরজা হিসাবে যে জিনিসটি রয়েছে, তাকে হয়তো কষ্টেশিষ্টে পর্দা বলা যেতে পারে। দেখে বোঝা যায়, এটি একটি এক কামড়া ঘর এবং এটি গোয়ালঘর হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। আমিও সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যাই। পরের বাড়িটির কাছ পর্যন্তও যাইনি, তিনটে বাচ্ছাছেলে ছুটে সামনে চলে এল। তিন জনই খালি গায়ে আছে। একজন প্যান্ট পরে থাকলেও বাকি দুজন পুরোই উলঙ্গ। বয়স কত আর হবে! বড় জোড় চার কি পাঁচ বছরের দুজন, আর একটা, আরও ছোট।

প্যান্ট পরা ছেলেটি অন্যদের বলে, ওই স্যারটা আগেও এসেছিল। দেয়ালে লিখে দিয়ে গেছে।

আমি ওদের জিজ্ঞাসা করি, এটা কাদের বাড়ি?

একজন তার নাক থেকে বের হওয়া সর্দিটাকে একবার টেনে ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করে বলে, এটা বাড়ি নয় গো, গোলচালা।

তোদের বাড়ি কোথায়?

দেওয়ালের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, ওদিকে, এই মাঠটার ওপাশে।

বুঝে যাই, ওরা বেরাপাড়ায় থাকে।

কার সাথে এখানে এসেচিস?

দাদুর সাথে।

দাদু কোথায়?

গরু বের করছে। ওদিকে আছে। এসো আমার সঙ্গে।

আমিও ওদের পিছু পিছু বাঁধ থেকে নিচের দিকে নামতে থাকি। এখানটায় কাদা নেই। খুব ছোট ছোট সিঁড়ির ধাপের আকারে মাটি কেটে তৈরি করা। বাঁধের উপর থেকে বোঝা যায়নি। নিচে বেশ সুন্দর পরিপাটি করা ঘরদালান। দেওয়ালে নানা রকম ছবি আঁকা। সেখানে লতা ও ফুলের আধিক্য চোখে পড়ে।

ছবিগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, কে এঁকেছে?

এবারে প্যান্ট পরা ছেলেটি উত্তর দেয়, এই পুরোনো গুলো ঠাম্মা এঁকেছে আর এগুলো মা করেছে।

আপন মনেই মুখ থেকে বেড়িয়ে যায়, বাঃ!

এমন সুন্দর করে এঁকে রাখা হয়েছে, চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রতিটি দরজা, জানালা, দেওয়ালে গর্ত কেটে তৈরি করা কুলুঙ্গি, সবার চারপাশেই বিভিন্ন নকশা এঁকে রাখা আছে। দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পরি।

কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে, এদিকে এসো।

দেখি একটা পর্দা মতো সরিয়ে ঢুকে গেল। আমিও ঢুকলাম। এটা শুধু একটা বেড়ার মতো কাজ করছে। কতকগুলো ছেঁড়া চটের থলেকে জুড়ে তৈরি। দেখি একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, লুঙ্গি পরে কাঁধে একটা গামছা নিয়ে গরু বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।

আমাকে দেখে বলে, একটু বোস, গরুটাকে বেঁধে দিয়েই আসছি। দেখি, পাশেই একটা সরু গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে, বলেন বাবু, কি জানতে চান?

আসলে আমি লোকগণনার জন্য এসেছি। আপনাদের বাড়িতে কে কে আছে, সবার নাম বলতে হবে।

ও তো বেরাপাড়ায় নিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, বেরাপাড়াতে আমিই গিয়েছিলাম। আপনাদের কি ওখানে হয়ে গেছে?

আমি তো এখানেই ছিলুম। বাড়িতে দুজন লোক এসেছিল, সব জিজ্ঞেস করে, সই করিয়ে নিয়ে গেছে।

তাহলে আপনাদের হয়ে গেছে। আসলে রিং বাঁধেও তো বাড়ি আছে, তাই এখানেও জিজ্ঞাসা করছি।

ও! তাই বলুন। এগুলো কারোর বাড়ি না। এগুলো সব গোলচালা। এদিকে প্রতি বছর বন্যা হয় তো, তাই বন্যার সময় গরু রাখার জন্য গোলচালা। এখানে সবগুলোই গোলচালা। এই তো এটাতে, আমাদের পাঁচ ভায়ের গরু থাকে। সবার আলাদা আলাদা। এর আগেরটা, ওটা আমারই একটা খুড়তুতো ভায়ের। এদিকে যাবে, পরপর দেখতে পাবে।

এখানে কেউ থাকে না?

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বন্যার সময় থাকে। তাছাড়া অন্য সময়, বাড়ি ছেড়ে কে পড়ে থাকবে! সবারই বাড়ি আছে। দিনের বেলায় কেউ কেউ মাঝে মধ্যে এদিকে আসে। নইলে সকালে এসে গরু ছেড়ে দিল, সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাক। আর বিকেলে একবার এসে গোলচালায় বেঁধে দিয়ে ধোঁ দিয়ে চলে গেল।

পুরো রিং বাঁধটাই এরকম?

না, বেরাপাড়ার গোলচালা পরপর আছে। তারপর আবার কিছুটা ফাঁকা মতো দেখবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি।

তারপরে আবার বেশ কয়েকটা আছে। তারপর একটা রাস্তা বেরাপাড়া থেকে বাঁধে মিশেছে। ওর পর থেকে মাইতিপাড়ার গোলচালা শুরু হল। সেখানে আবার কেউ কেউ বাঁধেই থাকে। আরও এগিয়ে গেলে, ফৈদর-বাউরিরা থাকে। ওরা ওখানেই থাকে।

হ্যাঁ দেখেছি, আগে একদিন এসেছিলাম। বাড়ি গুলোতে নম্বর দিয়ে গেছি। এবারে শুধু কার কার গোলচালা, তাদের নামগুলো লিখে নেব।

লিখে নাও, বলে দিচ্ছি। এ আর এমন কি কাজ!

আমি, আমারই তৈরি করা ম্যাপের একটা জেরক্স কপি বের করে নিই। কথার ফাঁকে দাদার নামটিও জেনে নিই। ওনার নাম মহাদেব বেরা। ওনার কিছু জমি জায়গা আছে। চাষাবাদ করে আর গরু ছাগল পুশেই সংসার চলে যায়। যা যেটুকু উপায় করে তার জোরেই এখনও গোটা সংসার আগলে রেখেছেন, ভাঙতে দেয়নি। পাঁচ ভাইয়ের তেরোজন ছেলে আর এগারো জন মেয়ে। ছেলেমেয়েদের কারোর কারোর বিয়েথা হয়ে গেছে। কিন্তু সবাই এক সংসারেই থাকি।

এই রে! এরকম তো বেরাপাড়াতে হয়নি। একটু বড় ফ্যামিলি আছে। কিন্তু এতো বড় ফ্যামিলি, আমি তো লিখিনি। শেষে মহাদেববাবুর বাড়িটি বেরাপাড়ার ঠিক কোন জায়গায়, জেনে নিই। আগের পূরণ করা রাফ কাগজগুলি বের করে মেলাতে থাকি। ওনার নাম পেয়েও যাই। কিন্তু আগে যিনি বলে দিয়েছিলেন, তিনি তো ফ্যামিলি ভেঙে দেখিয়েছেন। তাই আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের বাড়িতে কি সকলের একসাথেই রান্না হয়?

তখন জানতে পারি, সকলের হেঁসেল আলাদা। আর তার ফলেই আলাদা ফর্মে সমস্ত তথ্য পূরণ করা হয়েছে। ওনাকেও বোঝানো সহজ হয়। যাইহোক, ওখান থেকেই রিং বাঁধের গোলচালার প্রতিটির তথ্য পেয়ে যাই। আর কোন সই করানোর প্রয়োজনও পড়ে না। একসাথেই হয়ে যায়। অনেকটা কাজ খুব কম সময়ে হয়ে যাওয়ায়, হাতে সময় পেয়ে যাই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে অফার করি। মহাদেববাবু জানান, তিনি এমনিতে সিগারেট খান না, তবে আজকে আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একটা ধরালেন। আমিও সিগারেট টানতে টানতে রিং বাঁধের গল্পে মেতে উঠি। ততক্ষণে বাচ্ছা তিনটি সরে গিয়ে কাদা নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে।

এখানে প্রতি বছর বন্যা হয়। সারা বছরে একবার হয়তো বন্যা সহ্য করা যায়। তাই এই রিং বাঁধ। অন্তত একদিকের জল তো আটকে দেওয়া যাবে। প্রায় পনেরো কিলোমিটার লম্বা একটা বাঁধ। যা শুধুমাত্র মাটি দিয়েই তৈরি।এখানকার মানুষের কাছে এই বাঁধটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই শুধুমাত্র মাটি দিয়ে তৈরি হলেও এটির দেখভাল এতই সযত্নে হয় যে কোনভাবেই অপর পাশের জল এদিকে আসতে পারে না। বাঁধের উপরে বহু গাছ খুব সুন্দর ভাবে ছাঁটা দেখে বোঝাই যায়, বাঁধটি রক্ষার জন্য গ্রামবাসীরা কোন ত্রুটি রাখে না।

যেখানে বেরাপাড়া থেকে রাস্তা এসে বাঁধে মিশেছে, সেই পর্যন্ত হয়ে যায়। সবকটিই বেরাপাড়ার গোলচালা। মানে রিং বাঁধের প্রায় তিন ভাগের একভাগ কাজ হয়ে গেছে। এখন মোটে পৌনে দশটা বাজে। আবার কাদাময় বাঁধের উপর দিয়ে যেতে হবে। তাই আর দেরি না করে বাঁধে উঠে পড়ি।

একটার পর একটা গোলচালার নম্বরের সাথে শুধু মিলিয়ে চলতে থাকি। একটা জায়গায় একটা গাছ ভেঙে পরে আছে। আর অন্তত একশো জন মানুষ সেখানে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বড় বড় করাত এনে বাঁধের উপরে পড়ে থাকা গাছ কাটছে। আবার কেউ কেউ কুড়ুল দিয়ে ডাল কেটে সরানোর চেষ্টা করছে। গতরাতের ঝড়ে ভাঙা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে গাছটি ভেঙে পড়েছে, আসলে সেটি একটি তেঁতুল গাছ। গাছে এখনও কিছু পাকা তেঁতুল আছে। আর তার জন্যই এখানে এতো লোক জমেছে, বুঝতে পারি। অনেকে আবার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাতব্বরি করছে, তাও দেখলাম।

ওদের বেশ কয়েকজনের সাথে সামান্য কথাবার্তার পর আবার এগিয়ে চলি। ক্রমে বেরাপাড়ার গোলচালা শেষ হয়। এখানে আর কোন ঘর নেই। মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে গাছ লাগানো হয়েছে। গাছ গুলিও বহুদিন আগেই লাগানো। এটা দেখে ভাল লাগে যে, গাছ লাগানোর সময় শুধুমাত্র কাষ্ঠল বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের কথাই মাথায় রাখা হয়নি। সেখানে শাল, সেগুন, শিশু যেমন রাখা হয়েছে, তেমনি তেঁতুল, পিয়ারা, কাঁঠালও আছে। আবার কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুলও দেখেছি।

তিন মাথার মোড়ে এসে উপস্থিত হই। এর পর থেকেই রিং বাঁধে মাইতিপাড়ার গোলচালা শুরু। এখানে আবার কিছু লোক বসবাসও করে। তাই প্রতি বাড়ি থেকেই তথ্য জোগাড় করতে হবে।

প্রথমেই যে বাড়িটায় ঢুকলাম, সেই বাড়িতে লোক বসবাস করে। তবে এটাকে বাড়ি না বলে ঝুপড়ি বলাই ভাল। কিন্তু আমাকে বাড়ি হিসাবেই দেখাতে হবে। ছিটেবেড়ার দেওয়াল, খোলার চাল। একচালা করে ছাওয়া। দুটি ঘর এবং সামনে একটু বারান্দা। পাশ থেকে যা মনে হয়, তাতে ঘরগুলির ভিতরের মাপ আট ফুট বাই দশ ফুটের বেশি হবে না। বারান্দাও খুব বেশি হলে ফুট চারেক চওড়া। আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর তিনটি মেয়ে। কোন রকমে চাষাবাদ করে সংসার চালান। নিজে লেখাপড়া জানেন না, তবে মেয়ে তিনটিকেই এখনও পড়াশুনায় দিয়ে রেখেছেন।

বড় মেয়ে সবে এইটে পড়ে। মেজ মেয়ে ফাইভে আর ছোটটা টুয়ে পড়ে। বড় দুজন এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে হাই ইস্কুলে যায়। আর ছোটটা বেরাপাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ে।

প্রত্যেকের নাম লেখার জন্য কাগজ বের করি। কিন্তু প্রথমেই খটকা লাগে। লোকটির নাম মহাদেব বেরা। আমি হঠাৎই জিজ্ঞাসা করে ফেলি, কজন মহাদেব বেরা আছে?

সামান্য হেসে বলেন, খুব অসুবিধা হয়। মাঝে মাঝে তো এর চিঠি ওর কাছে চলে যায়। তবে রিং বাঁধে আমি একাই থাকি। আর বেরাপাড়ায় মোট তিনজন মহাদেব বেরা আছে। তাদের দুজনের বাবার নামও আবার শুকদেব বেরা।

আমি বেরাপাড়ায় দুটো পেয়েছি। আর দুটো ঘর বাকি আছে।

একেবারে শেষ ঘর - আর একটা মহাদেবের। ওর বাবার নামও শুকদেব বেরা। ওর আগের বাড়ি হেমন্ত বেরার।

বুঝে যাই, এই দুটি বাড়িই আমার বাকি আছে। মহাদেববাবুর কাছ থেকে সমস্ত তথ্য জেনে নেওয়ার পর ফর্মে সই করতে বলি। উনি তখন ওনার মেয়েদের ডাকেন। একজন এলে, তাকেই সই করতে বলেন।

বুঝতে পারি, মেয়েটি ওনার বড় মেয়ে। দেখে মনে হয়, দশ বারো বছরের একটা জীর্ণ বাচ্ছা! এই মাত্র দুটো ঘরে ওনারা মোট আটজনে গাদাগাদি করে থাকে। মহাদেববাবুর বিধবা মা, দুটি অবিবাহিত বোন, স্ত্রী ও তিন কন্যা। সকলের খাবার জোগাড় করাই এখন সব থেকে বড় চিন্তা মহাদেববাবুর। যেটুকু জায়গা জমি আছে, তাতে চাষাবাদ করে সারা বছরের ভাতও জোটে না। তাই চাষের কাজ যখন থাকে না, তখন অন্যের কাছে তাঁত চালানোর কাজ করে। এখানে বাড়ির মধ্যে একটা তাঁত বসানোর মতোও জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়েই কম মজুরিতেও কাজ করতে হয়।

এগুলি এখানে সকলের জন্য প্রযোজ্য। তাই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। জেনে নিই, মাইতিপাড়া শুরু হবে আরও কিছুটা পর থেকে। এখানে আট দশ ঘর মতো আছে। তারপরে আবারও গোলচালা। সেগুলোই সব মাইতিপাড়ার গোলচালা। ওখানে বাঁধের নিচের দিকে দুঘর বিহারী বাস করে। এখানে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। ওরা থালা বাসনের ব্যবসা করে। এখানে প্রায় তিন পুরুষ হয়ে গেল। এইসব শুনে নিয়ে পাশের বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই।

সব কটি শেষ হলে দেখি, এখানে এগারোটি ঘর ছিল। তার পর থেকে সব গোলচালা। আস্তে আস্তে এগোতে থাকি। ঘড়িতে প্রায় এগারোটা বাজে। একটা সিগারেট ধরিয়ে পিঠের ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করি। হঠাৎ দেখি, সামনে কুন্তলবাবু।

স্যার, আপনি আবার এলেন?

এই, সব জায়গায় স্যার স্যার করবি না তো। দে আগে একটা সিগারেট দে।

আমিও প্যাকেট বাড়িয়ে দিই। একটা সিগারেট বের করে বলে, দেখচিস তো একটা হাত ভাঙা। দেশলাইটা জ্বালাবো কি করে?

আমিও দেশলাই জ্বালিয়ে সামনে ধরে, জিজ্ঞাসা করি, আবার এলেন কেন, আমি করে নিচ্ছিলাম তো।

তোকে সকালে একা ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই মন থেকে স্থির হতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পরে বেড়িয়ে পরি। এবারে আর কালীমন্দিরের দিক দিয়ে আসি না। বেরাপাড়ার পাশ দিয়ে আসি। একটু আগেই মহাদেব বেরার কাছ থেকে জেনে এদিকে আসছি। কিন্তু প্রশান্ত কোথায়?

ও আসেনি।

ঠিক আছে, বিডিও সাহেবকে জানতে হবে।

কি হবে! তার থেকে ছেড়ে দিন, আমাদের কাজ আমরাই করে নেব। এখনও অনেক সময় আছে। আর কাজও খুব বেশি বাকি নেই। আজই শেষ হয়ে যেতে পারে। না হলেও খুব বেশি বাকি থাকবে না।

চলো তাহলে।

আমরা বাঁধ ধরে এগোতে থাকি। ওই তো বাঁধ থেকে নিচের দিকে নেমে গিয়ে একটা টালির চালের বাড়ি রয়েছে। বাড়িটি বাঁধের অন্য বাড়িগুলির তুলনায় অনেক বড়। যাইহোক, বাঁধ থেকে নেমে বাড়ির সামনে চলে আসি। এখানে একটা কাঠের তৈরি দরজা দেখতে পেলাম। কড়া নাড়া দিলাম।