Two hundred and fifty paisa in Bengali Fiction Stories by Kalyan Ashis Sinha books and stories PDF | দুটাকা পঁয়ষট্টি পয়সা

Featured Books
Categories
Share

দুটাকা পঁয়ষট্টি পয়সা

সেদিন স্কুলে ঢোকার সাথে সাথেই প্রধান শিক্ষক মহাশয় ডেকে পাঠালেন। কি ব্যাপার! যাইহোক, প্রথমেই কুন্তলবাবুর কাছে জরুরী তলবের কারণ পেয়ে গেলাম। আজ সবে ফেব্রুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ। আর আঠাশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে, এই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের যাবতীয় তথ্য জোগাড় করে, নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে হবে। আর এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং, আজই দুপুর দু'টো থেকে, এস.আই. অফিসে দেওয়া হবে। এই কাজটি আসলে সেনশাস ডিপার্টমেন্টের। কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকার কারণে আমাদের করতে হবে।

কি আর করা যাবে! এক্ষেত্রে অপশন তো একটাই। তাই না মেনে উপায়ই বা কি! একে তো আমাদের স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকা মিলিয়ে মোটে তিনজন। সর্বশিক্ষার কারণে রান্না করার জন্য তবু দুজনকে পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনজন শিক্ষক শিক্ষিকার মধ্যে যদি দু'জনকে প্রায় এক মাসের জন্য অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়, তখন স্কুল চলবে কিভাবে?

স্কুল চলবে কিভাবে, তা স্কুল বুঝবে। আমাদের কাছে উপর থেকে যেমনটি নির্দেশ এসেছে, আমি শুধু তেমনটিই করতে বলেছি। স্কুলও চালাতে হবে, আবার সেনশাসের কাজও করতে হবে। তবে এই কাজ সারা দিনের যে কোন সময়ে করতে পার। এই বলে জয়েন্ট বিডিও সাহেব শুরু করলেন। আর তাতেই বুঝে গিয়েছিলাম কাজটির গুরুত্ব কতখানি। কাজটিকে শেষ করতেই হবে। কিন্তু এখনও ঠিক জানি না, কাজটি ঠিক কতখানি বড়! তার জন্য আমাদের ঠিক কতটা সময় খরচ করতে হবে। শুধু একটি কথাই জানি, আমাদের আঠাশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করতে হবে।

বেশ কিছুক্ষণ এটা ওটা চলার পর, এই ব্যাপারে দক্ষ একজন কর্মী আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়ে দেন। একটা ফর্ম হাতে তুলে দেখান, এটিতে অনেক ডিজিট লিখতে হবে। এবং ফর্মে দেখানো পদ্ধতিতেই সংখ্যা গুলি লিখতে হবে। ততক্ষণে আমাদের প্রত্যেকের কাছে একটি করে জেরক্স করা ফর্ম দেওয়া হয়েছে। দেখলাম প্রায় চল্লিশটি স্তম্ভ রয়েছে। তবে বেশিরভাগটাই পূরণ করা সোজা। অল্প কয়েকটি, বাড়ির যে কেউ একজনের সাহায্যে পূরণ করা যায়।

মোটামুটি পাঁচটা পর্যন্ত ট্রেনিং চলল। তার পরে আমরা যে যার বাড়ি চলে গেলাম। আর তখনই জেনে গেলাম, প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজনীয় ফর্ম নয় তারিখে এস.আই. অফিস থেকে নিতে হবে।

পরদিন যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছে স্বাভাবিক কাজকর্ম নিয়ে পড়লাম। টিফিনে ছাত্রছাত্রীদের খাওয়া হয়ে গেলে, কুন্তলবাবু ও আমি, কুন্তলবাবুর সাইকেলে চেপে আমাদের কতটা জায়গা ঘুরে দেখতে হবে তা জানার জন্য বের হলাম। আমাদের শুধু বলে দেওয়া হয়েছে একদিকে খাল ও অন্যদিকে পাবলিক লাইব্রেরির মাঝের পাড়াগুলি আমাদের দুজনের ভাগে পড়েছে। তাই পাশাপাশি হওয়ায় একসাথে কাজ করতে পারবো। কিন্তু স্কুলে উনি আমার প্রধান শিক্ষক! যদিও কোন দিন এই ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়নি।

প্রথম দিন বেড়িয়েই বুঝতে পারি, কাজটির পরিমান কি বিশাল! আমাদের প্রত্যেককে প্রায় পাঁচশো'র মতো বাড়ি গুনতে হবে। মানে পাঁচশোর বেশি ফর্ম পূরণ করতে হবে। ভেবেই ভয় হচ্ছে। কোন উপায় যখন নেই, তখন কাজটিকে কিভাবে সংক্ষেপে করা যায়, ভাবতে শুরু করি। ভাবতে ভাবতে পেয়েও যাই। আর ঠিক করে ফেলি, কোন পদ্ধতিতে কাজটি আমরা করবো।

ন'তারিখ প্রথমে স্কুলে গিয়ে সই করে আসতে হল। আর এখানে, নাম ধরে ডেকে ফর্ম দেওয়া হচ্ছে। তাই আমাদের চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। অথচ স্কুলে ফিরে যেতেও পারব না। সিস্টেমের উপর রাগ হলেও, নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। বসে বসে বোর হচ্ছিলাম। দেখি, দূর থেকে কুন্তলবাবু হাত নেড়ে ডাকছেন। আস্তে আস্তে বাইরের দিকে এগিয়ে গেলাম।

এখানে বসে থেকে কোন কাজ নেই। শান্তিদা ফর্ম দিচ্ছে। ওনাকে বলে দিয়েছি, আমরা চারটে'র পরে আসছি। শান্তিদাও সম্মতি দিয়েছে। আমরা সোজা স্কুলে চলে এলাম। দেখি, একা সোমাদির অবস্থা খুব খারাপ। কোন ভাবেই চারটে ক্লাসকে একসাথে সামলাতে পারছে না। একটা রুমে ছাত্রছাত্রীদের চুপ করাতে না করাতেই, অন্য রুম থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আর সোমাদিও শুধু এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে চলেছে। আমাদের দেখতে পেয়ে যেন স্বস্তি ফিরে এল। যাইহোক, সবাই ফিরে আসাতে স্কুল যেন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল।

স্কুল ছুটি হয়ে যাবার পর, আবার কুন্তলবাবুর সাথে এস.আই. অফিসে গেলাম। দেখি, তখনও হইহই হয়ে চলেছে। তবে এখন বেশিরভাগ ফর্মই বিলি হয়ে গেছে। আমরা ফর্ম নিতে গিয়ে দেখি, মোটে দেরশোটি করে ফর্ম দেওয়া হচ্ছে। এই ফর্মগুলি জমা নেবে সতেরো তারিখ। ঐদিন আমাদের একটা ম্যাপও এঁকে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে প্রতিটি বাড়ির নম্বর উল্লেখ করতে হবে। বুঝে যাই, কাজটি কতটা কঠিন এবং এই সাত দিনেই আসল কাজ হয়ে যাচ্ছে। এরপর শুধু মিলিয়ে নেওয়ার পালা।

পরদিন সকালে একটা খারাপ খবর পেলাম। বাথরুমে পড়ে গিয়ে কুন্তলবাবু হাত ভেঙে ফেলেছেন। বুঝতে পারি, পুরো কাজটাই আমাকে করতে হবে। তাই, সোমাদিকে নিয়ে টিফিন পর্যন্ত স্কুল চালিয়ে বেড়িয়ে পরি। কতকগুলি সাদা কাগজ সঙ্গে নিই। একটা দাগ দিয়ে রাস্তা বুঝিয়ে, তার দুপাশের বাড়িগুলি নম্বরের আকারে লিখি। অন্য একটি কাগজে বাড়ির প্রধানের নাম লিখি। এটা করার জন্য সব বাড়ি ঘুরতেও হচ্ছে না। এক জায়গায় বসে বসেই হয়ে যাচ্ছে। বাধ সাধলো রিং বাঁধ আর চকের বেরাপাড়ায় এসে।

রিং বাঁধে যাদের বাড়ি, তাদের প্রত্যেকেরই অন্য জায়গায় বাড়ি আছে। এগুলি শুধু বন্যার সময়ে ব্যবহার করা হয়। বছরের অন্য সময় গুলোতে, সাধারণত গোয়ালঘর বা মজুতঘ‍র হিসাবেই ব্যবহার বেশি। তাই এগুলিকে বাড়ি না গোয়ালচালা - কি হিসাবে দেখাবো? এখন যা পাচ্ছি, তাই দেখাই। কিন্তু এখানে যে অনেক ঘর আছে। শুধু রিং বাঁধেই প্রায় সাতশো ঘর পাচ্ছি।

আর চকের বেরাপাড়া - এখানে অগুনতি ঘর রয়েছে। ঘ‍রের ভিতরে ঘর, বারান্দার একপাশ ত্রিপল দিয়ে ঘিরে ঘর। তবুও যতটা সম্ভব, প্রায় প্রতিটি বাড়ির নম্বর আলাদা ভাবে লিখতে থাকি। শুধু এই কাজটি করতেই দুদিন চলে যায়। যাইহোক, এখন অন্তত বুঝতে পারি, আমাকে তেরোশোর মতো ফর্ম পূরণ করতে হবে। কিছু কুন্তলবাবুর ভাগে দেখতে হবে, বাকি আমার ভাগে।

এই পর্যন্ত করার পর দেখি, চকের ফৈদরপাড়া আর মাইতিপাড়া বাদ পরে গেছে। যাইহোক, এই দুই পাড়াতেই একই বংশের লোকের বাস হওয়ায়, এক জায়গায় বসে বসেই পুরো হিসাবটা পাওয়া গেল। আর বাড়ির সংখ্যাও তেরোশো পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল।

আজকে বারো তারিখ। কুন্তলবাবু প্লাস্টার করা ভাঙা হাত নিয়েও আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। আর আমি একের পর এক ফর্ম পূরণ করে সই করিয়ে নিচ্ছি। আজকে সকাল থেকে এই দুপুর পর্যন্ত ঘুরে মোটে সাতটা ফর্ম পূরণ করা হয়েছে। কিভাবে শেষ হবে কে জানে! দুপুরে একটা ছায়া দেখে, সেখানে বসে টিফিন সারলাম। আর কুন্তলবাবুকে কিভাবে সহজে কাজটি করা যায় বললাম। দেখি কুন্তলবাবু তো প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।

এরপর থেকে আমরা নতুন উপায় ধরলাম। একটা করে রাফ কাগজে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে লিখে নিতে থাকলাম এবং নির্দিষ্ট ফর্মে সই করিয়ে নিচ্ছিলাম। বাকি দীর্ঘমেয়াদী বসে বসে পূরণ করার কাজ বাড়িতে সেরে নেওয়া যাবে। দুপুরের পর থেকে প্রায় ঘণ্টা তিনেক মতো কাজ করার সময় পেয়েছি। আর তাতেই সই করা ফর্মের সংখ্যা আশি পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে ফর্মগুলি পূরণ করে ফেললাম। পরদিন সকালেও একই পদ্ধতিতে বাকি ফর্মগুলি সই করানোর পরে স্কুলে চলে এলাম।

এখন বিভিন্ন স্কুলের স্যার ম্যাডামদের থেকে নানান কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। কত নম্বর স্তম্ভে কি লিখতে হবে, তা নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলছে। সব কথায় কান দিতে না চাইলেও শুনতে হচ্ছে। যাদের যেভাবে বলে দেওয়া সম্ভব, তা বলে দেওয়ার চেষ্টা করাতে দেখতে পেলাম, কেউ কেউ অযথা সমস্যা তৈরি করছেন। তখন তাদের এড়িয়ে যাওয়া ভালো বলে মনে করলাম। আর কুন্তলবাবু কিন্তু, ভাঙা হাত নিয়েও আমায় সর্বদা সাহায্য করে চলেছেন।

যাইহোক, সতেরোই ফেব্রুয়ারি আমরা আমাদের তৈরি করা ম্যাপ ও সমস্ত পূরণ করা ফর্ম নিয়ে এস.আই. অফিসে গেলাম। দেখি সেখানে শুধুই হইহই হচ্ছে। বেশ কয়েকজন রয়েছেন, যাদের একটি ফর্মও সম্পূর্ণ পূরণ করা হয়নি। কোথাও না কোথাও বাদ থেকে গেছে। দেখলাম, সেগুলি নিয়েই আলোচনা বেশি হচ্ছে। কিন্তু একজনকেও পেলাম না, যাকে আমার মতো এতোগুলো ফর্ম পূরণ করতে হবে। প্রত্যেকের ভাগেই একশো থেকে একশো কুড়িটার মতো বাড়ি পড়েছে। এটা জানার পর, আমি কুন্তলবাবুকে নিয়ে জয়েন্ট বিডিও স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। সব শুনে তিনি আমাদের জন্য আরও, নতুন একজন এনুমারেটরের ব্যবস্থা করবেন জানালেন। তবে আমাদের একসাথেই কাজ করতে হবে। সেদিনই তিনি প্রশান্তবাবুকে আমাদের সাথে কাজ করার জন্য দিলেন। আরও সাতশোটির মতো ফর্ম দিলেন। যদি আরও ফর্ম লাগে, যেন এক সপ্তাহ পরে নিই। আমাদের কাজ মোটামুটি ঠিকই হচ্ছে বলে জানালেন। শুধু একটি জায়গাতেই জোড় দিতে বললেন, দেখো কারোর নাম যেন দুবার না ওঠে এবং কেউ যেন বাদ না যান।

প্রশান্তবাবু সেচ দপ্তরে কাজ করেন। একটি গভীর নলকূপ, যা থেকে এখানে সেচের কাজ হয়, সেখানে পাম্প চালানোর কাজ করেন। প্রথমেই উনি জানিয়ে দিলেন, দেখুন স্যার, আমি লেখাপড়া খুব বেশি জানি না, কোথায় কি লিখতে হবে বলবেন, ঠিক লিখে ফেলতে পারব। কাজ তো আর ফেলে রাখলে হবে না। কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে। দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে।

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে, আঠারো তারিখ সকালে আটটার সময় ফৈদরপাড়ার সামনে দেখা করবো জানালাম। আটটা শুনেই প্রশান্তবাবু বললেন, সে কি করে হবে! সকালে বাজার করতে হবে, মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি করি না কেন, এগারোটার আগে তো হবে না।

দেখলাম, তর্ক করা বৃথা। তাই ওনাকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি এগারোটাতেই আসবেন। তবে মাইতিপাড়ায় দেখা হবে।

পরদিন আমি ও কুন্তলবাবু ফৈদরপাড়া থেকে শুরু করলাম। পর পর বেশ ভালভাবেই চলছিল। কিন্তু পাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় একটা ত্রিপল ঘেরা ঘরে এসে, সবকিছু গুলিয়ে গেল। যিনি উত্তরদাতা, তাঁর কথা যদি সত্যি হয়, তবে ওনার এবং ওনার মায়ের বয়সের তফাৎ মোটে চার বছর, আবার ওনার এবং ওনার নাতির মেয়ের বয়সের তফাৎ মোটে চব্বিশ বছর। এইসব শুনে আমরা থ!

শেষে কুন্তলবাবুই একটা সহজ উপায় বলে দিলেন। সবথেকে কম বয়সীর বয়স থেকে হিসাব শুরু করে, উল্টোপথে হিসাব করে সবার আনুমানিক বয়স বলে দিলেন। যা বড় বন্যার সাথে মিলিয়ে উত্তরদাতার বয়স বললেন, যা প্রায় মিলে গেল। এর পরে ফৈদরপাড়ায় আর কোন অসুবিধা হয়নি। দেখি, সবে দশটা বাজছে। কুন্তলবাবুকে বললাম, স্যার আপনি বরং স্কুলে চলে যান, ওইদিকটা দেখুন। আমি প্রশান্তবাবুকে নিয়ে মাইতিপাড়া শেষ করে চকের বেরাপাড়া ধরি।

তোমার অসুবিধা হবে না তো? আমিও তো হাত ভেঙে পড়ে আছি।

না স্যার, অসুবিধা হবে না। আপনি স্কুলে থাকবেন। সোমাদি তাহলে নিশ্চিন্তে স্কুল চালিয়ে নেবে।

ঠিক আছে, কোন অসুবিধা হলে স্কুলে চলে এসো।

ঠিক আছে স্যার।

আমিও আর দেরি না করে মাইতিপাড়ার দিকে হাঁটতে থাকি। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে আগুন দিই। ধোঁয়া টানতে টানতে মাইতিপাড়ার দিকে হেঁটে চলেছি। একটা সরু আলপথ দিয়ে রাস্তা। রাস্তায় কোন এক সময় ইট পাতা হয়েছিল। এখন ভাঙা টুকরোয় এসে ঠেকেছে। ঘাসের জঙ্গল হয়ে গেছে। তবু যেখানে ইট বিছানো ছিল, সেখানে একটু কম। আর দুপাশের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, কেউ যেন আধ হাত পুরু কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। বোঝাই যায়, এই পথে লোক চলাচল খুব কম হয়।

চকের মাইতিপাড়ায় ঢোকার সময়, রাস্তাটা যেখানে দুভাগ হয়ে গেছে, সেখানে প্রশান্তবাবু মেয়েকে সাইকেলে চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডানদিকে মাইতিপাড়া। আমাকে দেখেই প্রায় লজ্জিত হয়ে বললেন, মেয়েকে স্কুলে দিয়েই এখুনি আসছি।

ঠিক আছে, আমি মাইতিপাড়াতেই থাকবো। তুমি এসে আমার সাথে যোগ দিও।

মাইতিপাড়ায় ঢুকে এক এক করে সব তথ্য জানতে থাকি ও লিখে রাখতে থাকি। ফর্মে উত্তরদাতার সই করিয়ে নিতেও ভুলি না। মাইতিপাড়ায় মোটে বারোটি ঘর থাকায় তাড়াতাড়িই হয়ে যায়। দেখি এগারোটা দশ বাজে। কিন্তু এখনও তো প্রশান্তবাবু এল না। কি আর করি! একটা সিগারেট ধরিয়ে বেরাপাড়ার দিকে হাঁটতে থাকি। জানি ওখানে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে! তবু যেতে তো হবেই।

এক ধার থেকে শুরু করলাম। দেখি যা ভেবেছিলাম, তার থেকেও দ্রুত কাজ হচ্ছে। এখানে এক জায়গায় বসে বসেই আশিটার মতো ফর্ম সই করানো এবং তথ্য জোগাড় করা হয়ে গেল। শুধু দু'ঘর বাকি থাকল, যারা এখন রিং বাঁধে থাকে। ঘড়িতে দেড়টার মতো বাজে। আজ বরং স্কুলে চলে যাই। কোনভাবে প্রশান্তবাবুকে একটা খবর দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমার কাছে ফোন নেই। প্রশান্তবাবুর ফোন নম্বর কুন্তলবাবুর কাছে আছে। ওনাকেই একবার ফোনে কথা বলে নিতে বলব।

এইসব ভাবতে ভাবতে স্কুলের দিকে হাঁটতে থাকি। প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটতে হবে। তবে স্কুলে পৌঁছাতে পারব। এই রোদে হাঁটতে হলে কে বলবে এখন বসন্ত চলছে! ঘামে চান করে না গেলেও, শরীরের জামাকাপড় ভিজিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে একটা হিসাব করে নিই। আজকে এখন পর্যন্ত খুব খারাপ কাজ হল না। বেরাপাড়ায় আশিটা, মাইতিপাড়ায় বারোটা আর ফৈদরপাড়ায় ঊনিশটা। মানে, মোট একশো এগারোটা। এগুলোকে আজকেই লিখে শেষ করে ফেলতে হবে। কোন ভাবেই ফেলে রাখা যাবে না।

স্কুলে ফিরে কুন্তলবাবুকে সবটা জানিয়ে ফ্রেশ হয়ে টিফিন সেরে নিলাম। সোমাদি জানালেন, আজ আর ক্লাস নিতে হবে না। উনি সব কটি ক্লাসেই কাজ দেখে পড়া দিয়ে রেখেছেন।

সব সময় সোমাদিকে ধন্যবাদ দিতেও পারি না। এই সব কাজের জন্য ধন্যবাদ দিতে গেলে, উনি আবার রেগে যান। তাই শুধু শোনা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

অন্য কোন কাজ না থাকায় ফর্মগুলি পূরণ করা শুরু করি। হঠাৎই দেখি প্রশান্তবাবু হাজির। বুঝে যাই, কুন্তলবাবুর থেকে ধাঁতানি খেয়ে তড়িঘড়ি এখানে এসেছেন। এসেই আমার থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে কাজ করতে চায়। কুন্তলবাবুই প্রশান্তবাবুকে কি করতে হবে বুঝিয়ে দেন।

প্রথমে একটি ফর্ম নিয়ে তার সব স্তম্ভ গুলি পূরণ করতে যায়। এবং কিছুটা লেখার পর, আবার কি লিখবে জিজ্ঞেস করে। তখন কুন্তলবাবু আমাকে বলে দিতে বলেন। আমি পূরণ করা একটা ফর্ম নিয়ে দেখিয়ে দিই। তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে, প্রশান্তবাবু যেভাবে ফর্মটি পূরণ করছেন, সেটি আসলে ক্যানসেল হয়ে যাবে। মানে, শুধু আরও একবার পূরণ করতে হবে তাই নয়, উত্তরদাতাকে খুঁজে তার সই করাতে হবে।

যাইহোক, এই একটি মাত্র ফর্মে ছাড়া আর কোন ভুল প্রশান্তবাবু করেননি। আমাদেরও খুব তাড়াতাড়ি সেদিনের সমস্ত ফর্ম পূরণ করা হয়ে যায়। হঠাৎ প্রশান্তবাবু বলেন, বাকি ফর্ম গুলোতে আগে থেকেই লিখে ফেলবো? তাকে বারণ করি। আগামীকাল রবিবার, স্কুল ছুটি। তাই আমরা রিং বাঁধ শুরু করবো ঠিক করে নিই। একইভাবে সকাল আটটায় রিং বাঁধের শুরুতে কালীমন্দিরের কাছে মিলিত হবার কথা হয়। প্রশান্তবাবু ন'টায় আসবেন জানালেন। তাকে বলি, রিং বাঁধ ধরে এগিয়ে যেতে, আমি আর কুন্তলবাবু ওখানেই থাকবো।

কিন্তু বিকাল থেকে যে গুমোট ভাবটা চলছিল, তা সন্ধ্যের পর যেন প্রকট হয়ে উঠল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। দশ পনেরো মিনিট যেতে না যেতেই বুঝতে পারি, ঝড়ের দাপট বাড়ছে। সাথে বাজ পড়াও শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকদিন সেনশাসের কাজের জন্য বৈঠকখানায় যাওয়া হয়নি। তাই আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে, স্কুল থেকে সোজা বৈঠকখানাতেই চলে এসেছি।

আজ আবার বিপিন এখানে নেই। কি একটা কাজে একবার কলকাতায় গেছে। কালকে ফিরবে। রঘুদা জানায়, গিন্নিমা খবর পাঠিয়েছেন। বামুনঠাকুর ছোটবাবুর জন্য একটা মেয়ে দেখেছে আর আমাদের সকলকে একবার গিয়ে দেখে আসতে বলেছেন। আমিও রঘুদাকে যাব বলে জানাই।

এদিকে ঝড়ের দাপট এমনই যে গাছপালাও উপড়ে ফেলবে বলে মনে হয়। কালকে সকালেই রিং বাঁধে যেতে হবে। এই ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি নামলে, তাহলে আর রক্ষে নেই। খালের পাশে উঁচু করে মাটির বাঁধ। বাঁধের উপরে ও একপাশে ঘর। এখানে মাটি ছাড়া অন্য কিছু নেই। তাই প্রচুর কাদা হবে। যা অতিক্রম করে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের মতো রিং বাঁধ শেষ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমি মনে করি, দু'দিনে কাজটি শেষ করা যাবে। কিন্তু যদি অন্য রকম হয়!

আর খুব বেশি ভাবার সময় ছিল না। বাইরে ঝড়ের সাথে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। বিপিনদের বাড়িতে এখনও ইলেকট্রিক আসেনি। তাই এখনও এই পুরানো বিশাল বাড়িতে লণ্ঠনের সাহায্যেই অন্ধকার তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এককালে এখানে বড় বড় ঝাড়বাতি জ্বলত, যা সারারাত চারিদিক আলোকিত করে রাখত। কিন্তু সে সব এখন ইতিহাস। বর্তমানের কালিপড়া লণ্ঠনের আলো শুধু একটা ভৌতিক অনুভূতি জাগাতে পারে। কিন্তু ঘরদোর আলোকিত করে তুলতে পারে না।

একা এইরকম পরিবেশ পেয়ে, বাইশনটির মাথার দিকে তাকিয়ে রঘুদাকে জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা রঘুদা, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যে চিতাটাকে জমিদারবাবু মেরেছিলেন, সেটি কোথায় গেল?

সে টা তো বাবু, জাদুঘরে আছে। বড় দাদাবাবুর ঘরে তার বিশাল ছালটা মাথা সমেত দেওয়ালে টাঙ্গানো থাকতো। কিন্তু একদিন, মেজদাদাবাবু ক'জন অফিসারকে ডেকে এনে এগুলো জাদুঘরে পাঠিয়ে দেন।

ও! মিউজিয়াম বলো!

ওই হল বাবু। তোমরা বল মিউজিয়াম, আর আমাদের কাছে ওসব জাদুঘর। কত পুরোনো অস্ত্র সস্ত্র ছিল। সেগুলোও দিয়ে দিয়েছে। কত কি বিক্রি হয়ে গেছে। সবার শরীরে জমিদারের রক্ত বইছে তো! কোন দিন জমিদার বাড়ির আচার আপ্যায়নে ঘাটতি দেখিনি। সে সব দিনের কথা কি আর ভুলতে পারি বাবু!

এদিকে বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে শান্তনু হাজির। এখানে এসে যথারীতি বিপিনের পায়জামা ও ফতুয়া পড়ে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলে। ভিজে জামাকাপড় ছেড়েই রঘুদাকে তাড়াতাড়ি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে। রঘুদাও শীঘ্রই মুড়ি, ছোলা, চানাচুর, পিঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা সহযোগে আমাদের সকলের টিফিনের ব্যবস্থা করে।

শান্তনু আমার লোকগণনার কাজ কেমন চলছে জিজ্ঞাসা করে। আমিও আমাদের কাজের হাল জানাই। শান্তনু বলে, দেখবি রিং বাঁধে যারা থাকে, তাদের আগেই গোণা হয়ে গেছে। ফৈদরপাড়া আর বেরাপাড়ার লোকেরাই রিং বাঁধে থাকে।

তা হলে তো সুবিধাই হবে। আমি রিং বাঁধের ঘর গুলিকে গোয়ালচালা দেখিয়ে দেব। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

না সব নয়। কিছু আবার ওখানেই থাকে।

যাইহোক, কাল সকালেই যাব ওখানে।

কথা বলতে বলতে আমাদের মুড়ি শেষ। দেখি, রঘুদা চা রেডি করে ফেলেছে। টিফিনের পর চা, সাথে একটা সিগারেট, আলাদা মৌজ এনে দেয়। শান্তনু আবার সিগারেট খায় না। একটা প্লাস্টিকের ডিব্বায় খৈনি ও চুন রাখে। যখন প্রয়োজন হয়, হাতে খৈনির সাথে চুন মিশিয়ে দলতে থাকে। শেষে ঝাড়ার পর মুখে পুরে তার রসটুকু খায়। একবার মুখে খৈনি পুরে অনেকক্ষণ মাঠে একভাবে কাজ করা যায়, তাই ........

এসবের ফাঁকে রঘুদার থেকে জেনে যাই, এককালে ফৈদরপাড়ায় ডাকাতরা বাস করতো। তাদের থেকেই বেছে বেছে জমিদার বাড়ির লেঠেল নিয়োগ হতো। তবে সে সব বহুদিন আগের কথা। এখন ওদের না আছে কোন জমি জায়গা, না আছে কোন টাকা পয়সা। এদিকে ওদিকে অন্যের জমিতে জনখেটে যেটুকু হয়, তাতে ভালভাবে পেটই ভরে না। এখন কেউ কেউ হকারি করতে বেড়িয়ে পড়েছে। তবে বাবু, ওদের খুব বেশি ঘাঁটাবেন না। আর দুপুরের মধ্যেই কাজ শেষ করে চলে আসবেন।

কেন গো রঘুদা?

এই তো না, এই জন্য তোমাদের কোন কথা বলতে নেই।

আচ্ছা আচ্ছা, আমি সকালে গিয়ে দুপুরের আগেই চলে আসবো।

ঠিক আছে। তোমরা একটু গল্প কর। আজ আর বাড়িতে গিয়ে রান্না করতে হবে না। এখানেই রান্না করে নিচ্ছি। খাওয়া দাওয়া সেরে বৈঠকখানাতেই থেকে যেও।

না গো রঘুদা, অনেক কাজ পড়ে আছে। এখানেই না হয় খেয়ে নেব। তার পর বাড়ি ফিরতে হবে।

সে তখন দেখা যাবেক্ষণ।

এই বলে রঘুদা ভিতরে চলে যায়। বাইরে ঝড় কমে এলেও, বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে পড়ছে। এমন অসময়ে বৃষ্টি, পরিবেশের উষ্ণতা খুব কমিয়ে দিয়েছে। এমন সময়ে শান্তনু উঠে বাইরের দরজাটা খোলে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠলে বাইরে বৃষ্টির বহর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতির কাছে মানুষ কতো তুচ্ছ - এই কথাটি পরিষ্কার বোঝা যায়। দরজার বাইরে প্রতিদিনের মতো ভুলো তার নির্দিষ্ট জায়গায় শুয়েছিল। এখন উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াচ্ছে।