★ 02 ★ A ★
লক্ষ্মীর মা আসলে নিমাইকাকার এক দূর সম্পর্কের দিদির মেয়ে। যে কিনা রেলের কাজ করতে আসা এক কুলির প্রেমে পড়ে যায়। বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলে, শেষে নিমাইকাকাই একটা ব্যবস্থা করে দেয়। ঠিক হয়, আমাদের পাড়াতেই, মাঠের দিকে নিমাইকাকাদের যে বাগান আছে, সেখানে একটা বাড়ি তৈরি করে, তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে। সেইমতো প্রথমে বাঁশ দিয়ে কাঠামো তৈরির পর ছিটেবেড়ার দেওয়াল তৈরি করা হয়। খড় দিয়ে চাল ছাওয়া হয়।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই, রেলের কাজ শেষ হয়ে যায়। আর কোন জমি জায়গা না থাকায় মহাদেবদাও কাজ হারায়। ফলে রত্নাদি আর মহাদেবদার সংসারে অভাবের সাথে ঝগড়া অশান্তি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। নদীতে যখন বেশি জল থাকে, তখন টুকটাক মাছ ধরা যায়। মাঠের মাঝে মাঝে যে পুকুর বিল আছে, সেখান থেকেও মহাদেবদা মাছ ধরার কাজ করে। অন্যের জমিতে খেটে আর ক পয়সা পাওয়া যায়!
ফলে প্রায় বাধ্য হয়েই রত্নাদি অন্যের বাড়িতে ঠিকে ঝি-এর কাজ আরম্ভ করে।কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কে আর অন্যকে বাড়িতে কাজে রাখবে? তাই শহরে থেকে কাজ করতে হয়। মাসের শুরুতে একবার বাড়ি আসে। দু-তিন দিন থাকে। আবার চলে যায়।
এদিকে প্রতি বছর রত্নাদি আর মহাদেবদার সংসারে একজন নতুন অতিথি আসতেই থাকে। যদিও এখন আর সব কজন বেঁচে নেই। তবুও চারভাই ও দুই বোন এখনো তাদের জীর্ণদশা জানান দিয়ে চলেছে।
যখন রত্নাদি বাড়িতে থাকে, তখন ভয়ে সবাই প্রায় তথষ্ট হয়ে থাকে। রত্নাদির মুখে কিছু আটকায় না। যখন তখন, যাকে তাকে যা খুশি গালাগালও পাড়ে। এদিকে মহাদেবদা শান্তিপ্রিয় ঠান্ডা মানুষ। তাই সব থেকে বেশি গালাগাল তাকেই হজম করতে হয়। আবার রত্নাদি ও মহাদেবদা বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকায়, লক্ষ্মীরা ছয় ভাই বোন কেউই স্কুলের মুখ দেখেনি।
লক্ষ্মীর ভাইগুলো সারাদিন মাঠে মাঠে গরু চড়ায়। ওদের গরু না থাকলেও, পাড়ার সব গরুদের ওরা চড়াতে নিয়ে যায়। বিনিময়ে সন্ধ্যের সময় কিছু খেতে পায়। এইভাবেই তাদের দিনগুলো কেটে যায়।
এদিকে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্মীদের বাড়ির কাছে এসে গেছি। হঠাৎ লক্ষ্মী, আমার হাতে চুবড়ি দুটি ও নুনের প্যাকেটটা দিয়ে বাড়ি যেতে বলে।
আমি চুবড়ি নিতে অস্বীকার করলে, জোড় করেই আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে। ও তিনদিন না খেয়ে আছে, তাই ওকেও আমাদের বাড়ি যেতে বললে, ও বলে-
তোমরা আছ, তাই তো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। দুপুরে আসবো। বলেই এক ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি জানি, ও এখন কোথায় যাবে। আমাদের বাগানের পাশে যে শিবমন্দির আছে, তার পাশে অনেকগুলি আঁশফলের গাছ আছে। এমনিতে আঁশফল লিচুর মতো খেতে হলেও, ওর আঁশটে গন্ধের জন্য কেউ খুব একটা খেতে চায় না। তাই কেউ ভাগ বসায় না। আর নিচ থেকেই পাড়া যায়, গাছেও উঠতে হয় না। শিবমন্দিরের চারপাশ লক্ষ্মীই সব সময় পরিষ্কার করে রাখে। মন্দিরের সামনের জবা আর টগর ফুলের গাছগুলোও ওরই লাগানো।
বাড়ি পৌঁছে দিদিকে সব বললাম। দিদি বলল, আজ বাড়িতে কিছু নেই, দুপুরে ভাত হবে। তাই ওকে দুপুরে একবার আসতে বলেছি। আমিও আর দেরি না করে, জমিতে বিল্টুর কাছে যাই।
★ 02 ★ B ★
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহের গরমে সবাই কাবু হয়ে গেছে। সকাল থেকেই আজ সবাই বাড়িতে। এদিকে আবার, আজই মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। এই গরমের মধ্যে, কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করছে না। আবার মনটাও ছটফট করছে। বিল্টুর তো কোন চিন্তা নেই। ও যেমন স্কুলে প্রতিবার ফার্স্ট হয়, সুরোজিৎস্যার বলেছেন, এবারে হয়তো বিল্টু মাধ্যমিকেও স্ট্যান্ড করতে পারে। কিন্তু আমি তো আর বিল্টুর মতো পড়াশোনায় অত ভালো না। বাকি সাবজেক্ট কোনক্রমে মুখস্ত করে উতরে গেলেও, অঙ্কে কি হবে! যদি ফেল করে যাই! তাই বিল্টু আগে জেনে আসুক, আমি বরং কাল স্কুলে গিয়ে মার্কশিট নিয়ে আসবো।
কিন্তু কদিন থেকেই আবার ঠাকুমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। গতরাতে তো দিদি আর পিসি সবসময় ঠাকুমার ঘরে বসেই কাটিয়েছে। আজ সকাল থেকে আবার, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গরমও বেড়ে চলেছে। সবে সকাল সাড়ে ন'টা। ট্রেনের আওয়াজ শোনা গেল। এখনই বাইরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তবুও আমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বাগানে শিবমন্দিরের কাছে গিয়ে বসি। এখানে অনেক বড় বড় গাছ থাকায় গরম অনেক কম। বসে বসে ভাবতে থাকি, ঠাকুর যেন পাশ করে যাই।
কেন যে অঙ্ক মাথায় ঢোকে না, বুঝতে পারি না। কত চেষ্টা করি, মাঝে মাঝে বিল্টুও রেগে যায়। কিন্তু একটা তেল মাখানো লাঠিতে একটা বানর উঠছে। তিনফুট ওঠে তো দুফুট নেমে যায়। এটা যদি অঙ্ক হয়, তাহলে মাথায় না ঢোকাই তো স্বাভাবিক। আমার তো স্বাভাবিক বুদ্ধিতে মনে হয়, বানরকে যদি লাঠিতে উঠতেই হয়, তবে শুধু শুধু তেল মাখানো কেন? আর বানরকেও বলি, এতো লাঠি থাকতে, তেল মাখানো লাঠিতে উঠতে গেলি কেন! আবার দেখো, জমিতে লাঙ্গল দেবে তো দাও। অথবা ট্রাক্টর দেবে তো দাও। কেউ তো আর বারণ করেনি। শুধু শুধু আমাদের অঙ্কে ফেল করানোর জন্য লাঙ্গলের বদলে ট্রাক্টর দেওয়া কেন?
তবে উপপাদ্য আমার খুব ভালো লাগে। কিছু বুঝতে হয় না। শুধু মুখস্ত করে নাও, তাহলেই হল। আর এই উপপাদ্যের জন্যই, আমি প্রতিবার পাশটা করে যাই। এবার পরীক্ষাতেও দুটো উপপাদ্যই লিখে এসেছি। ছ'দুকুনে বারো। এই বারোটা নম্বরে কেউ হাত ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তারপর কি হবে? পাশ করতে গেলে তো আর বারো পেলে হবে না।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওই দূরে ডুলুং নদীর পাড় দেখা যাচ্ছে। মাঝে কয়েকটি জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তারপর পাথুরে জমি। কোন কিছু হয় না। আর এই রোদের সময়, এতো গরম হয়ে যায় যে খালি পায়ে হাঁটাও যায় না, পায়ে ফোঁসকা পড়ে যায়। তবুও এই পথেই সবাই নদীতে যায়। সেখানে স্নান সেরে খাওয়ার জল নিয়ে আসে।
সৌরভদা, তরমুজ খাবে? কালকে গরু চড়াতে গিয়ে গোকুল এনেছে। আমার দিকে একফালি লাল তরমুজ বাড়িয়ে লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে।
ওর হাত থেকে নিয়ে একটা কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করি, তুই খেয়েচিস?
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
বুঝে যাই, এটা ওর ভাগের। ওরটাই আমাকে দিয়েছে। তাই একটু খাওয়ার পর, আবার ওকে দিয়ে দিই। ও'ই বাকিটা খেয়ে নেয়।
হঠাৎ দিদির ডাকে ঘুরে তাকাই। ঠাকুমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যদি একবার মানিকপাড়া হাসপাতালে গিয়ে জানিয়ে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়! উঠে পরি। গত সপ্তাহে হাটের পর আমার কাছে দু'শো বত্রিশ টাকা এখনও আছে। টাকাটা নিয়ে, একটু জল খেয়ে বেড়িয়ে পড়ি। এতোটা পথ পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। সঙ্গে একটা গামছা নিয়ে নিই।
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় লক্ষ্মী আমার সঙ্গে যেতে চায়। ওকে পাত্তা না দিয়েই বেড়িয়ে পড়ি। এই গরমের মধ্যে গামছাটা মাথায় রেখে হাঁটতে থাকি। এমনিতে শীত বা গরম, যে কোন সময়ই মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে, মাঠের মধ্যে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। আজ কিন্তু অন্য রকম লাগছে। আসলে আমি কোনদিন মা'কে দেখিনি। "মা" কি হয়, তা বুঝতে হয়েছে পিসি, দিদি, ঠাকুমার থেকে। আর সেই ঠাকুমাই এতো কষ্ট পাচ্ছে। -এটাই আজকে আমায় গরমের মধ্যেও টেনে নিয়ে যায়। চুপচাপ হাঁটতে থাকি।
পথে আমি একজনকেও দেখতে পাই না। আমারও তাড়া থাকায় বেশ জোরেই হাঁটতে থাকি। সারা শরীর ঘামে চান করে গেছে। মুখে গরমের হল্কা লাগায়, গামছাটার একটা খুঁট মুখে ঢেকে রেখে চলেছি। চাঁদনীর মোড়ে এসে দাঁড়াই। এমনিতে মানিকপাড়া যেতে গেলে, চাঁদনী হয়ে, বানপুরা, মহুলবানী, রাজাবাঁধ হয়ে যেতে হয়। এই পথে পাঁচ ছয় ক্রোশ হাঁটতে হবে। পথের পাশে গাছ থাকায়, ছায়াও পাওয়া যাবে। কিন্তু এই গরমের মধ্যেও এই পথ বাদ দিয়ে রেল লাইনের দিক দিয়ে যাবার চিন্তা ভাবনা করি। রেল লাইন ধরে গেলে, প্রায় দুই ক্রোশ পথ কম হবে।
সময় বাঁচানোর জন্য চাঁদনী মোড় থেকে ডুলুং নদীর পাড় ধরি। কিছুটা যাবার পর রেলব্রীজ পড়বে। সেখান থেকে রেল লাইন ধরে নেব। হাঁটছি তো হাঁটছিই। পথ যেন শেষ হয় না। কপালের ঘাম চোখে পড়ে চোখগুলো জ্বালা জ্বালা করছে। গামছাটা দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিই। একদিন ছাড়াই তো এই পথে মানিকপাড়া যাই। এতো কষ্ট হয় না। আজ যেন সারা গা পুড়ে যাচ্ছে। তবুও হাঁটতে থাকি।
সামনে রেলব্রীজ দেখতে পেয়ে, একবার নদীতে নেমে পড়ি, চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার আশায়। কিন্তু নদীর জল এখন খুব গরম হয়ে গেছে। এরপর থেকে মানিকপাড়া পর্যন্ত কোথাও জল পাব না। কোথাও কোন ছায়াযুক্ত জায়গাও পাব না। তাই গরম জলই চোখে মুখে দিয়ে নিই। গামছাটাও ভিজিয়ে নিই। খেয়েও নিই বেশ খানিকটা। শরীরটা একটু ভালো বোধ হয়। উঠে পড়ি।
রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকি। গরমের কষ্ট কমানোর জন্য, প্রতিটি পা ফেলার সাথে সাথে মনে মনে গুনতে থাকি। একশো হয়ে গেলে আবার এক থেকে শুরু। যখন বিল্টুর সাথে একসাথে স্কুলে যেতাম, তখন বিল্টুই শিখিয়েছিল। আর এইভাবে গুনতে থাকলে কষ্টের কথা মনে আসে না। তাই কষ্টও কম হয়। কিন্তু আজ কোন কিছুতেই যেন রোদের তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না।
বেলা তখন প্রায় বারোটা হবে। মানিকপাড়া হাসপাতালের আউটডোরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আগে দশ বারো জন আছে। তাদেরই একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কি হয়েছে? আমি ঠাকুমার কথা জানালে, আমাকে বলে আগে ভিতরে গিয়ে সিস্টার দিদির সঙ্গে কথা বলতে। তার কথা মতো আমিও সিস্টার দিদিকে ঠাকুমার কথা জানাই। সিস্টার দিদি ঠাকুমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার কথা বলে। কিন্তু আমি পাঁচ ক্রোশ হেঁটে এখানে এসেছি এবং এখন কোন ভাবেই ঠাকুমাকে এখানে আনা সম্ভব নয় জেনে, আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে যান।
ডাক্তারবাবু আমাকে ডেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠাকুমার কথা জিজ্ঞেস করেন। আমিও ঠাকুমাকে যেমন যেমন দেখেছিলাম তাই বলতে থাকি। সব শুনে ডাক্তারবাবু ঠাকুমাকে স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়ার কথা শোনায়। এও জানান, বাড়িতে ব্যবস্থা করতে গেলে অনেক খরচ হবে। যে যাবে, সে'ও বেশ কিছু পয়সা নিয়ে নেবে। তবুও ডাক্তারবাবু একটা কাগজে কি সব লিখে দেন। সিস্টার দিদি আমাকে ডেকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে আসেন। আমাকে জানায়, ঠাকুমাকে কোন ভাবে হাসপাতালে আনতে পারলে সবটা ফ্রিতে হয়ে যেত। অন্য একটা কাগজে কি একটা লিখে আমার হাতে দিয়ে বলে, রাজাবাঁধ থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসতে। সেখানে মেডিকিওর মেডিসিন হলে লেখাটা দেখালে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে দেবে। সেখানে বললে ওরাই লোক পাঠিয়ে দেবে।
সেইমতো আমিও রাজাবাঁধের দিকে বেড়িয়ে পড়ি। এই ওষুধের দোকানটা আগে থেকেই চিনি। তাই খুঁজতে হল না। দোকানে কোন খদ্দের নেই। দোকানদারকে লেখাটা দেখালে, বলে মোট দু'শো চল্লিশ টাকা লাগবে। টাকাটা দিয়ে গেলে, দোকান বন্ধ হবার পর স্যালাইন ও অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেবে।
আমার কাছে অতো টাকা নেই।
টাকা নেই তো এখানে এসেছ কেন? শুধু শুধু সময় নষ্ট করা! যাও, আগে টাকার জোগাড় করো, তারপর এখানে আসবে।
আমার কোন কথাই আর শুনতে চায় না। কি আর করি! দু'শো বত্রিশ টাকা নিয়ে, আবার হাসপাতালের দিকে যাই। এখন হাসপাতালটা ফাঁকা। গরমে এতো কষ্ট হচ্ছে যে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সামনের সরকারি কল থেকে জল খাই। খুব ঠাণ্ডা জল। চোখে মুখে বেশ খানিকটা দিয়ে নিই। এখন অনেকটা স্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু চোখের সামনে থেকে ঠাকুমার শ্বাসকষ্ট যেন কিছুতেই সরছে না। আবার আউটডোরের দিকে যাই।
কেউ কোথাও নেই। বাইরের দালানে দুটো কুকুর গুটিসুটি মেরে ঝিমোচ্ছে। আমার আওয়াজে কান গুলো শুধু নড়ে উঠলো। একজন একবার ঘার তুলে দেখে আবার শুয়ে পড়ল। আমিও সামনের দিকে এগিয়ে যাই। একটু আগেই এখানে কতো সবাই ছিল। যারা ডাক্তার দেখাতে এসেছিল, তাদের হয়ে গেলে তারা না হয় চলে গেছে, কিন্তু ডাক্তারবাবু বা সিস্টার দিদি কোথায়? তাদের তো দেখতে পাচ্ছি না। ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু, বলে ডেকেও কোন উত্তর পাই না।
কি করবো, কিছুতেই বুঝতে পারি না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। এ কোন জাদু! একটু আগেই সবাই ছিল, এখন সব কিছু থাকলেও কোন মানুষের দেখা নেই। হঠাৎ সবাই যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি, হয়তো দুপুরে চান খাওয়া সারতে গেছে। তাই বলে এইভাবে সব কিছু খুলে রেখে চলে যাবে! আমিও এদিক ওদিক ঘুরে দেখি। যদি অন্য কোন ঘরে গিয়ে থাকে, তাই ভিতরের দিকে এগিয়ে যাই।
সবকিছু ঠিকঠাক আছে, শুধু কোন মানুষ নেই। সব ঘরেই উঁকি মেরে দেখি। একটা ঘরে ঢুকে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। দরজা খোলাই ছিল। শুধু একটা ভারী পর্দা টাঙানো আছে। পর্দা সরিয়ে ভিতরে মুখ বাড়াই। ভিতরটা বেশ অন্ধকার। কেউ নেই। না! ঐ কোনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে! অন্ধকারে চোখটা সয়ে আসতেই, মুখ থেকে আর কোন শব্দ বেড়োয় না। ঘরের কোনে একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। আমার শরীরে কেমন যেন একটা ঠান্ডা শিরশিরাণি অনুভব করি। মুখের লালাও যেন শুকিয়ে গেছে। কঙ্কালটা একেবারে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। হাত পা গুলো যেন আর আমার বশে নেই। পিছিয়ে আসতে চাইলেও, কে যেন আমার পা গুলো আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।
এই ছাড়ো! এখানে কেউ দেখে ফেলবে।
কে আছে মানিকপাড়ায়! শুধু তোমার জন্যই এখানে পড়ে রয়েছি। আজ আর কেউ আসবে না।
আমার সম্বিত ফেরে। মানুষের কথাবার্তা শুনে, আমার মাথা থেকে ভুত সরে যায়। এতক্ষণে অন্ধকারটাও সয়ে গেছে। পা গুলোও আমার বশে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসি। বাইরে থেকে ডাক্তারবাবু, সিস্টারদিদি বলে ডাকতে থাকি।
সিস্টার দিদিই প্রথমে বেড়িয়ে আসেন। আমাকে দেখেই, আমার উপর রেগে যান।
এখানে এসেছো কেন? আউটডোরে গিয়ে দাঁড়াও। জানো না, এখানে না বলে ঢুকতে নেই।
আমিও কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসি। আউটডোরের সামনে কুকুর দুটো এখনও শুয়ে রয়েছে। চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। এখন কুকুর গুলোও আমার দিকে তাকায় না।
বেশ কিছুক্ষণ পর, সিস্টার দিদি আউটডোরে এলে ওষুধের দোকানের সবটা গুছিয়ে বলি। এও জানাই, আমার কাছে মোট দুশো বত্রিশ টাকা থাকলেও, বাকি আট টাকা নেই। এটা শুনে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, আবার ভিতরে চলে গেলেন।
এবারে আমার বেশ রাগ হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে আমায় ভিতরে ডাকলেন। আবারও সেই ঘরে গেলাম। এখন আর কঙ্কালটা দেখে ভয় পেলাম না। সিস্টার দিদিই আরও একটা পর্দা সরিয়ে, আরও ভিতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। চামড়ার গদিতে মোড়া একটা চেয়ারে ডাক্তারবাবু বসে রয়েছেন। সামনের টেবিলে একটা আলো জ্বলছে। ডাক্তারবাবু আমায় বসতে বললেও, আমি দাঁড়িয়েই থাকি।
তোমার ঠাকুমাকে কোনভাবে হাসপাতালে আনা যাবে না?
দেখছি, বলে বেরিয়ে আসি।
যখন বাড়ি পৌঁছাই, তখন বিকেল হয়ে গেছে। বাড়িতে সব কথা বলে, একটা গরুর গাড়ি জোগাড় করতে বেরিয়ে পরি। গ্রামাঞ্চলে গরুর গাড়ি সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু গোকুল আর নকুল এখনও গরু নিয়ে ফেরেনি। তাই যতক্ষণ না ফিরছে, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবুও একটা গাড়ি বাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। ভিতরে একটা বিছানা মতো পেতে রাখলাম। যতটা কাজ এগিয়ে রাখা যায়।
সন্ধ্যার দিকে গোকুলরা ফিরলে, ওরাই দুটো ষাঁড়কে গাড়িতে জুড়ে দেয়। নকুল আমাদের সাথে যাবে। ঠিক হয়, ঠাকুমাকে নিয়ে আমি আর পিসি যাব। বিল্টু এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। রাস্তায় ওর সাথে দেখা হলে, ওকেও তুলে নেব। কিন্তু আমি জানি, ওর সাথে দেখা হবার প্রশ্নই ওঠে না। লক্ষ্মীও আমাদের সঙ্গে যাবে বলে। আমি বারণ করলেও, পিসি ওকে গাড়িতে তুলে নেয়। ক্যাচকোঁচ শব্দ তুলে গাড়িও চলতে শুরু করে।
গরুর গাড়িতে মানিকপাড়া যেতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। সন্ধ্যার পর গরম একটু কমেছে। ফুরফুরে হাওয়াও দিচ্ছে। ঠাকুমার কষ্টও একটু কমেছে বলে মনে হচ্ছে। নকুল একটা টিমটিমি জ্বেলে গাড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমরাও আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছি। সারাদিনের ক্লান্তির পরে, গরুর গাড়ির ছাউনির ভিতরে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি আসতে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতে পারি না।
লক্ষ্মীই ডেকে তোলে। দেখি, হাসপাতালে পৌঁছে গেছি। সবাই মিলে ধরাধরি করে ঠাকুমাকে নিয়ে যাই। সিস্টারদিদি জানায়, ডাক্তারবাবু এইমাত্র বেরিয়ে গেছেন। ওনাকে কোয়ার্টার থেকে ডেকে আনতে হবে। সেইমতো আমিও ডাক্তারবাবুকে ডাকতে যাই।
ডাক্তারবাবু ঠাকুমাকে দেখে জানালেন, ভয়ের কিছু নেই। স্যালাইন দিয়ে দিয়েছেন, আশা করা যায়, আর কিছু হবে না। তবে কাল যদি আবার শ্বাসকষ্ট হয়, তখন অক্সিজেন দিয়ে দেবে। কেউ একজন যেন রাতে থাকে। অসুবিধা হলে, আবার ডাকলে তিনি আসবেন।
ঠাকুমার কাছে পিসি আর লক্ষ্মী হাসপাতালে থেকে যায়। আমি আর নকুল বাইরে গরুর গাড়ির কাছে গিয়ে বসি। নকুল গরু গুলোকে গাড়ি থেকে খুলে, একটা গাছের গোড়ায় বেঁধে দিয়েছে। আউটডোরের সামনে, যেখানে দুপুরে কুকুর গুলোকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, আমরা এখন সেখানেই আশ্রয় নিয়েছি। নকুল তো একপাশে গামছা পেতে শুয়েই পরেছে। আমি একা চুপচাপ জেগে বসে আছি।
বাইরে একটা ইলেকট্রিকের বাতি জ্বলছে। তাতে এখানকার সব অন্ধকার দূর হয়েছে, বলা যায় না। তবুও সামনের অনেকটা অংশ আলোকিত হয়ে রয়েছে। বাঁ দিকে সরকারি চাপা কলটাও এখানে বসেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ডানদিকে রাস্তার উল্টোদিকের নারকেল গাছ গুলোকেও ভালোই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কুকুর দুটোকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া, দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। কানের কাছে মশার শনশনানি অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বাধ্য হয়েই গামছা দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে রেখেছি।
রাত বোধ হয় আর বেশি বাকি নেই। তবে ঠিক কতটা, বুঝতে পারি না। একটা রাতজাগা পাখি তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। বোধ হয় একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল, চমকে উঠলাম। দেখি, কখন কুকুর দুটোও পায়ের কাছে এসে শুয়েছে। উঠে পড়লাম। কলের কাছে এসে দেখি, জল নেমে গেছে। চাপাকলের হ্যাণ্ডেলে অনেকবার পাম্প করার পর জলের আওয়াজ পেলাম। ভালো করে চোখেমুখে জল দিলাম, পেট ভরে জল খেলাম।
পাশে যেখানে গরু দুটো বাঁধা রয়েছে, সেখানটা একবার ঘুরে এলাম। মনের ভিতরে একটা অজানা আতঙ্ক দানা বাঁধছে। রাতের আকাশে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। পরিষ্কার আকাশ। রাতের আকাশের অন্ধকার নীল রঙ মন ভরিয়ে দেয়। আজ কিন্তু মনে হচ্ছে, কখন সকাল হবে! আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসলাম।