একে নতুন চাকরি, তার উপর নতুন জায়গা। চারিদিক দেখতে দেখতেই সময় কেটে যায়। আপাতত একটি হোটেলে আছি। চাকরি থেকে ফিরে, প্রতিদিনই বিকালে বাসার সন্ধানে বের হই। রাতে হোটেলে ফেরা, এটাই যেন গত এক সপ্তাহের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আজকের বিকালটা একটু অন্য রকম ছিল।
অফিসের মাধববাবুই এই কদিন আমার সাথে বাসা খুঁজতে বের হচ্ছিলেন। আজকে অফিস থেকে বেরিয়েই মাধববাবু বললেন, স্যার আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?
ছোটবেলা থেকে না দেখে দেখে, বিশ্বাসটা একেবারে উড়ে গেছে। আর এতদিন তো কোলকাতায় কাটিয়েছি। ওখানে মানুষের ভিড়ে ভুতেরাও হারিয়ে গেছে।
তাহলে স্যার, রবিনসন সাহেবের বাংলোটা একবার দেখতে পারেন।
সেটা আবার কোথায়?
এখান থেকে কিলোমিটার দশেক মতো দূরে। তবে স্যার, ওটার কিন্তু খুব বদনাম আছে।
কি রকম শুনি?
যে'ই ওখানে রাত কাটাতে গেছে, তারাই শুনেছে।
কি শুনেছে?
রাতে কারা যেন ছাদের উপরে হেঁটে বেড়ায়। মাঝরাতের পর থেকে আর একটি অন্য শব্দও শোনা যায়। মনে হয় যেন একটা মেসিন চলছে। একটা ভারি রোলারকে রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলে যেরকম শব্দ হয়, সেই রকম শব্দও পাওয়া যায়। কেউ একদিনের বেশি থাকতেও পারে না।
বাংলোটা কেমন? মানে ভুতকে যদি বাদ দেওয়া হয়, তবে কেমন?
স্যার এমনিতেই অনেক দিনের পুরানো। আমি প্রায় বছর খানেক আগে দেখেছিলাম।
এখনও ফাঁকা আছে?
এখানকার কেউ সন্ধ্যার পর বাংলোর দিকে তাকায়ও না। মনে হয় ফাঁকাই আছে। চলুন না একবার, দেখে আসি।
চলো তাহলে।
আমি মাধববাবুর বাইকের পিছনে উঠি। পাহাড়ি রাস্তায় প্রচুর বাঁক থাকে। তা স্বত্তেও আমার মাথায় হেলমেট নেই। কোলকাতায় এটা ভাবতেই পারতাম না। আর এই এক সপ্তাহে কদাচিৎ বাইক আরোহীর মাথায় হেলমেট চোখে পড়েছে। তবে এখানে গাড়ি চলে খুবই আস্তে। আর প্রত্যেকেই নিয়ম মেনে চলতে চায়, শুধু হেলমেটটি বাদ দিয়ে।
আমাদের আধঘণ্টা মতো লাগলো। যে বাড়িটির সামনে মাধববাবু আমাকে নিয়ে এলো, সেটির চারপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কিন্তু প্রধান ফটকটি উন্মুক্ত। পাঁচিলের বাইরে একটি কালো রঙের পাথর বসানো আছে। তাতেই 'রবিনসনের বাংলো' কথাটি ইংরাজিতে লেখা আছে। কিন্তু এখানে যে সালটির উল্লেখ রয়েছে, সেটি মনে হয় ভুল করে লেখা হয়ে গেছে। এটিতে লেখা রয়েছে, স্থাপিত: ১৭৫২। মানে, তখনও মোগল সাম্রাজ্য চলছে।
এতো দিন হয়ে গেল, তবুও কি সুন্দর রয়েছে। বাড়িটি একটি পাথরের তৈরি দোতলা বাড়ি। চারপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রধান ফটক থেকে হেঁটে ভিতরের দিকে চলি। বাড়িটার সামনে উঁচু বারান্দা। মাধববাবুও বাইকটা একপাশে রেখে আমার সাথে আসছেন।
সব দরজা জানালা বন্ধ করা আছে। অনেকদিন ব্যবহার হয়নি, দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু এতো বড় বাড়ি, যদি কেনার কথা বলে, তো হয়ে গেল! ভাড়ায় পেলে থেকে যেতে পারি। মনে মনেই ভাবতে থাকি।
আমি কি তোমাদের সাহায্য করতে পারি?
তাকিয়ে দেখি, কোট প্যান্ট টুপি পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাঁর কাছে এগিয়ে যাই। আমি যে বাড়িটায় ভাড়ায় থাকতে চাই, এ'ও জানাই।
তোমরা জান নিশ্চয়ই, এই বাড়িটার একটা বদনাম আছে।
শুনেছি।
বাড়িটা আসলে আমার খুড়তুতো দাদু বানিয়েছিলেন।
কিন্তু এখানে যে সালের উল্লেখ রয়েছে,
সেটি ভুল করে লেখা।
দাদু কি করতেন?
আমরা জাতিতে পর্তুগিজ। আমার বাবার দাদু পর্তুগাল থেকে চা ব্যবসার জন্য এখানে আসে। এখানকার পরিবেশ এতোটাই ভালো লেগে যায় যে, চা বাগানে সামান্য একটা কাজ নিয়ে এখানেই থেকে যায়। এখানেই স্থানীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করে। তাঁর দুটি ছেলে। আমার দাদু এখানে বেশ মানিয়ে নেন। কিন্তু খুড়তুতো দাদু অন্য প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি এখানে পরে না থেকে, ব্যবসা করতে বেরিয়ে পড়েন। যদিও এখানকার পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনোই ছিন্ন হয়নি।
একবার, সালটা মনে হয় ১৯৫২ হবে, ফিরে এসে এই বাড়িটা বানায়। তিনি আবার বিয়েথা করেননি। এই বাড়িতেই বসবাস শুরু করেন। প্রায় প্রতিদিনই পার্টি হতো। লোকমুখে প্রচার হয়ে যায়, ব্যবসা করতে গিয়ে রবিনসন গুপ্তধন পেয়েছে। আর যা নাকি এই বাংলোতেই কোথাও লুকানো আছে।
খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার পর, হঠাৎ একদিন রাতে রবিনসন খুন হন।
সেটা কোন বছর?
সেটাই আসলে ১৯৫২।
ও!
আমি তখনও হইনি। বাবার কাছে শুনেছি।
আপনারা তাহলে কোথায় থাকেন?
ওই যে ওদিকটায়, আমাদের আরও একটি বাড়ি আছে, এখন তো শুধু আমি একাই পরে আছি। বাকি সবাই এখান থেকে পর্তুগালে ফিরে গেছে। বাড়ি দুটো বিক্রি হয়ে গেলে আমিও এখান থেকে চলে যাব।
দেখুন, আমি তো ভাড়া নেওয়ার জন্য এসেছিলাম। তাছাড়া সবে চাকরিতে ঢুকেছি। বাড়িটা এতো বড় যে, আমার পক্ষে এখুনি তার দামও জোগাড় করা সম্ভব হবে না।
দেখো কি করবে!
হঠাৎ মাধববাবু বলে, দাদু একটা কথা বলি কি, যদি কিছু মনে না করেন।
না না, মনে করব কেন, খোলা মনে বল।
বলছিলাম, স্যার বরং একসপ্তাহ এখানে কাটিয়ে দেখুক। তারপর না হয় কিছু একটা ভাবা যাবে।
যা ভালো বোঝ তোমরা। তবে আমার বয়সের কথা ভেবে খুব বেশি দেরি কোরোনা।
তাহলে কাল থেকেই আমি থাকবো। একবার ভিতরটা পরিষ্কার করিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো।
এই বয়সে আমার পক্ষে তো আর সম্ভব না।
ছিঃ! ছিঃ! আপনি পরিষ্কার করবেন কেন? আমরাই করে নেব।
তোমরা একটু দাঁড়াও। তোমাদের একবার ভিতরটা দেখাই। একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমাকে বাড়ি থেকে চাবিটা নিয়ে আসতে হবে।
চলুন, আমরাও যাই। বলে দাদুর সাথে আমরাও এগিয়ে যাই। আর একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়াই। বাড়িটির সামনে একজন অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে গুনগুন করে গান করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা দাঁড়িয়ে পরি।
দাদু বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। আমাদের কাছে এসে বলে, ওটা আমার নাতনি। ওর নাম মেরী। ও বাইরে থেকে পড়াশোনা করে। কিছুদিন পরই আবার চলে যাবে।
আমরাও দাদুর সাথে হাঁটতে থাকি। বাংলোর সামনে যে বড় তালাটা ঝুলছে, সেটিতে চাবি লাগিয়ে একটু চেষ্টা করতেই খুলে যায়। আমরা ভিতরে ঢুকি। অনেকদিন পরে থাকার জন্য ভিতরের বাতাসটা কেমন যেন বদ্ধ হয়ে রয়েছে। মাধববাবুই জানালাগুলো খুলে দেয়। ভিতরের সমস্ত আসবাবপত্র পুরানো। তবে পরিষ্কার করে নিলেই চলবে। নিচে মোট ছয়টি ঘর, আর উপরে চারটি।
উপরের একটি ঘর বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে। জানতে পারি, এই ঘরটাই রবিনসনের শোয়ার ঘর ছিল। জানালা খোলা থাকলে, ঘরের ভিতর থেকেই সূর্যোদয় দেখা যাবে। জানালার বাইরে তাকালে অসাধারণ পাহাড়ি দৃশ্য চোখে পরে। কিন্তু এই ঘরটিতে একটি খাট, একটি চেয়ার ও একটি ছোট টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই।
বাড়িটায় এখনও ইলেকট্রিক আসেনি। তবে ইলেকট্রিক না থাকলেও খুব অসুবিধা হবে না। এখান থেকে দাদুর বাড়ির সামনেটাও দেখা যাচ্ছে।
কাল থেকেই এখানে থাকবো, জানিয়ে দিই। যদি পছন্দ হয়ে যায়, তারপরে কেনাকাটার জন্য দরদাম করা যাবে। দাদুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, মাধববাবুর সঙ্গে বেড়িয়ে পরি।
যেতে যেতে মাধববাবু বলে, স্যার একটা কথা বলি কি,
হ্যাঁ, বলো না। আর একটা কথা, সবসময় স্যার স্যার কোরো না।
তাহলে চলুন, আজ একটু খাওয়া যাক!
কি খাবে?
কি আবার! একটা বোতল নিয়ে নেব, দুজনে হয়ে যাবে। একটু রাত করে ঘরে ঢুকলে বউ জানতে পারবে না।
আমরা দুজনে একটা পানশালায় ঢুকি।
পরদিন মাধববাবু আমার জন্য একজন নেপালী চাকর জোগাড় করে এনেছেন। সারা সপ্তাহ বাড়িতে থাকবে। শুধু শনিবার রাতে ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আবার রবিবার রাতে চলে আসবে।
প্রথমবার নির্মল থাপাকে দেখেই ভালো লেগে যায়। আমার থেকে বয়েসে একটু বড়। আগে ট্রেকারদের সঙ্গে মালপত্র বয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু একবার পরে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়ায়, আর পারে না। আমার কাছে বাড়ির কাজ করতে কোন অসুবিধা হবে না। ও আজ থেকেই শুরু করবে।
আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পরি। মাধববাবুই আমাদের পৌঁছে দেয়। দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘরে আমরা থাকবো ঠিক হয়। এই ঘর দুটোকেই নির্মল আগে পরিষ্কার করে দেয়।
সত্যি, নির্মলের তুলনা নেই। আধঘণ্টার মধ্যেই ঘরগুলোকে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলেছে। মাধববাবুর সাথে বেরিয়ে আজকের বাজার দোকানও করে নিয়েছে। আমি জানালা খুলে রেখে বিছানায় বসে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখছি। এমন সময় দেখি, নির্মল অসাধারণ সুন্দর চা বানিয়ে এনেছে। এমন সুন্দর চা, এর আগে কখনও খাইনি। প্রসংশা না করে পারি না।
সন্ধ্যার দিকে মাধববাবু চলে যায়। আমিও সময় মতো নির্মলের সাথে পাহাড়ের গল্পে মেতে উঠি। নির্মল জেনে নেয়, রাতে আমি কখন খাব। একবার বাইরে বেরিয়ে চারপাশটা দেখে আসে। ফিরে এসে জানায়, বাবু বাইরে কয়েকটি বড় গাছ দিয়ে ছাদে ওঠা যায়, আবার সহজে নেমে পড়াও যায়। আর সিঁড়ির শেষ প্রান্তে কোন গেট না থাকায়, যে কেউ বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে। তবে কোন অসুবিধা নেই।
রাতে খাওয়া দাওয়া ভালোই হল। সত্যি! নির্মলকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। সবকাজ কি সুন্দর দক্ষতায় করে চলেছে। পাহাড়ি লোকজন বুঝি, এমনই সুন্দর হয়!
রাত তখন বোধহয় এগারোটার মতো হবে। এতো রাতে পাহাড়ে কেউ জেগে থাকে না। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আজ এই বাংলোয় প্রথম রাত! কি হয় কে জানে! এতোটা দুঃসাহস না দেখালেই মনে হয় ভালো হতো। কিন্তু হোটেলে আর কতদিন থাকবো? তবে এটাই স্বান্তনা যে আমি একা নই। আমার সাথে নির্মল আছে।
হঠাৎ শুনতে পাই, কেউ যেন আমার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে। ভালো করে শুনতে চেষ্টা করি। হ্যাঁ, দরজা থেকেই আসছে। নির্মলকে ডাকবো! না, আগে দরজাটা খুলেই দেখি।
দরজা খুলতেই দেখি, নির্মল দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে চুপ করতে বলে। হাতের ইসারায় আমাকে ডেকে নিয়ে চলে। আমিও ওর পিছন পিছন অগ্রসর হই। ও আমাকে নিয়ে দোতলার একটা কোনে একটা আলমারির পাশে লুকায়।
এমন সময় ছাদের উপর পায়ের শব্দ শোনা যায়। বেশ কয়েকজন বলে মনে হয়। ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারি না, তবে তিনজন আছে। সিঁড়ি দিয়ে সোজা একতলায় নেমে যায়। আমরাও শব্দ না করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসি। দোতলা থেকেই দেখতে থাকি। আমরা যে বাড়ির ভিতরে আছি, মনে হয় বুঝতে পারেনি।
একটা টর্চ জ্বলে ওঠে। একতলায় মাঝে যে বড় টেবিলটা আছে, সেটাকে তিনজন মিলে ঠেলে সরায়। দেখি, নিচের দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। একজন দাঁড়িয়েই থাকে, আর দুজন নিচে নেমে যায়। নিচে থেকে রোলার চালানোর মতো শব্দ পাই। কি করছে বুঝতে পারি না। আমরাও লুকিয়ে দেখতে থাকি। চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে। ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে না পারলেও, একটা অসামাজিক কাজ যে হচ্ছে বুঝতে পারি।
প্রায় ঘণ্টা খানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এখন শুধুই অপেক্ষা করার পালা। হঠাৎ নির্মল আমাকে ঠেলা দেয়। দেখি, লোকদুটো নিচে থেকে একতলায় উঠে এল। তাদের সাথে একটা বড় ব্যাগও আছে, দেখলাম। আবার তিনজনে ঠেলে টেবিলটাকে যথাস্থানে করে দিল, এখন আর বোঝার উপায় নেই। আমরাও সরে এসে আবার আলমারির পাশে লুকাই। যে পথে তিনজনে এসেছিল, সেই পথেই তারা ফিরে যায়।
আমরাও বেরিয়ে আসি। নির্মল বলে, সন্ধ্যার সময় গাছ গুলোকে দেখেই বুঝেছিলাম, এখান দিয়ে কেউ যাতায়াত করে। তবে মনে হয় আজ আর কেউ আসবে না।
তুমি আমাকে ডেকে তোলার আগে জানলে কিভাবে?
বাবু, আমার একটা বদ অভ্যাস আছে! প্রতিদিন শুতে যাবার আগে আমি এককাপ দেশি খাই। আর সেটা একেবারে খোলা আকাশের নিচে খেতেই বেশি ভালোবাসি। এখানে তো সে সুযোগ নেই, তাই ঘরে আলো নিভিয়ে বাইরের জানালাটা খুলে দিই। জানালা খুলতেই নিচে কারোর নড়াচড়া বুঝতে পারি। তারপরেই আপনাকে ডেকে তুলি।
এবারে বুঝলাম। তাহলে, আজকে রাতে শুরু করে দাও।
নির্মল হেসে ফেলে।
পরদিন সকালে দাদু দেখতে আসে। তাঁকে সব ঘটনা জানাই। মাধববাবুকেও ফোন করে ডেকে নিই। এরপর দাদুকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে সবটা জানাই।
যদি তোমাদের কথা সত্যি হয়, তাহলে হয়তো একটা বড় গ্যাং ধরা পরতে পারে। আর একটা কথা, তোমরা আর কাউকে ঘটনাটা বোলো না। তাহলে ওরা সাবধান হয়ে যেতে পারে।
থানা থেকে বেরিয়ে আমি ও মাধববাবু অফিসে চলে আসি, আর দাদু বাড়ি ফিরে যান।
বিকালে আমার ফোনে একটা কল আসে। নম্বরটা চিনতে পারি না। রিসিভ করতেই জানতে পারি, থানা থেকে এসেছে। আজকের জন্য আমাদের বড় আলো জ্বালতে বারণ করেছে। ওরা বাইরে থেকে নজর রাখছে।
সন্ধ্যার দিকে চারজন বাড়িতে আসে। তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যায়, তারা মেলেটারিতে রয়েছে। তারা একতলার টেবিল সরিয়ে নিচে নেমে যায় এবং আমাদের টেবিলটা টেনে দিতে বলে।
আজকে একটা মারাত্মক ঘটনার স্বাক্ষী থাকতে চলেছি। নানা রকম উৎকণ্ঠা মনের মধ্যে ভিড় করে। বেশিরভাগ সময় নির্মলের সাথেই রয়েছি। সারে আটটার দিকে রাতের খাওয়া সেরে ফেলি। এবার আলো নিভিয়ে শুধুই অপেক্ষা। আবার আজকে নাও আসতে পারে।
আজকে নির্মল আমার ঘরেই রয়েছে। মাঝে মাঝে জানালাটা আস্তে করে খুলে একবার করে নিচটা দেখে আসছে। সময় যেন আজকে কাটতেই চাইছে না। ফোনটাতে দেখে নিই, সবে সারে দশটা বাজে। মানে, কালকের মতো হলে, আরও প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। চুপচাপ এইভাবে অপেক্ষা করা যে কি বিরক্তিকর, তা ভালোই বুঝতে পারছি।
একটা জলের বোতল থেকে কিছুটা জল খাই। নির্মল জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা পাল্লা ফাঁক করে। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস ভিতরে ঢুকে একটা কাঁপুনি ভাব ধরায়। নির্মল বাইরে উঁকি মারে। মনে হয় কিছু দেখতে পেয়েছে। হাতের ইসারায় চুপ থাকতে বলে। আঙুল দিয়ে দেখায়, আজকে চারজন এসেছে। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকলে চোখ সয়ে যায়, আজ আরও একবার দেখলাম।
এর পরের ঘটনা সামান্যই। পুলিশ ও মেলেটারিদের সাহায্যে চারজনেই হাতেনাতে ধরা পড়েছে। এরা বহুদিন থেকে জাল টাকা ছাপানোর কাজ করতো। এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বাকি গ্যাংটারও খোঁজ পেয়েছে।
রবিনসনের বাংলোর বদনামও দূর হয়েছে। আমার সাথে মেরীর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরও আমরা রবিনসনের বাংলোতেই থেকে গিয়েছি। নির্মলও আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে।
তবে, দাদুর আর পর্তুগাল যাওয়া হয়নি।