কাজ শেষ করে এবারে আজকের মতো বাড়ির দিকে যাব। দেখি, হাতে কিছুটা সময় আছে। তাই মেলটা একটু চেক করে নিতে বসি। মেল খুলতেই চোখে পড়ে, গত দু'ঘণ্টায় সাতশো বাহান্নটি মেল ঢুকেছে। সবকটি মেল চেক করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ম্যাসেজ না খুলেই ডিলিট করে দিই। কিছু ম্যাসেজ খুলে দেখতে হয়।
এমনিতে আমার ফেসবুক থাকলেও, প্রায় খোলাই হয় না। তাই আমাকে কেউ খুব একটা ট্যাগও করে না। এদিকে মেল চেক করতে গিয়ে দেখি, বারো মিনিট আগের একটি পোস্টে আমাকে ট্যাগ করা হয়েছে। কিন্তু এখন তো ফেসবুক খুলে দেখার মতো সময়ও নেই। রাতে একবার দেখে নেব ভেবে পরের ম্যাসেজে চলে যাই।
শান্তনু বলে, কিরে, তোর হয়ে গেলে ওঠ এবার।
চল।
বলে ফোন বন্ধ করে উঠে পড়ি। গলি পেড়িয়ে সামনের রাস্তায় সবে উঠেছি, দেখি, কৌশিক একটা ট্রলি ভ্যান নিয়ে রাস্তা দিয়ে খুব জোরে এগিয়ে আসছে। শান্তনুই তাকে জিজ্ঞেস করে, এই এতো জোরে যাচ্ছিস কেন?
সামনে একটা বড় এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি যাচ্ছি। বলেই হুস করে বেড়িয়ে যায়। দেখি পিছন থেকে একটা টোটো গাড়ি আসছে। ততক্ষণে শান্তনু বলে, চলতো, দেখি একবার, কি হয়েছে।
চল।
বলে আমরা এগোতে যাব, এমন সময় টোটোর ভিতর থেকে একজন বলে, শান্তনুদা উঠে এসো, এ্যাক্সিডেন্টের ওখানে যাবে তো?
টোটো দাঁড়াতেই আমরা উঠে পরি। ভিতর থেকে একজন বলে, এই ওখানে পুলিশ থাকবে না তো, আমার কাছে কিন্তু মদ আছে। এই রাত্রিবেলায় হাঙ্গামায় জড়াতে চাই না।
চুপ কর তো।
বেশি দূর যেতে হয় না। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে। একটা আলু বোঝাই ট্রাক রাস্তার ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকটি বিশাল, ওভারলোডও আছে বলে মনে হয়। এমনিতে এই ট্রাক গুলোতে চারশো প্যাকেটের মতো আলু ধরে। তবে এটাতে পাঁচশো প্যাকেটেরও বেশি আছে বলে মনে হলো।
আমরা ট্রাকটির পিছনেই নেমে পরি। এখানে কোন আলো না থাকলেও, চাঁদের আলোতে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। দেখি অন্তত জনা পঞ্চাশেক ছেলে শুধু এদিক ওদিক করছে। সবাই কেমন উদভ্রান্তের মতো ট্রাকটির চারপাশে ছুটোছুটি করছে। আমি আর শান্তনু ট্রাকটির বাঁদিক দিয়ে এগিয়ে যাই।
ট্রাকটির সামনে আসতেই বুঝতে পারি আসল ঘটনা। ট্রাকটি একটি ইঞ্জিন ভ্যানকে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছে যে, ভ্যানটি ট্রাকের সামনে আটকে গেছে। আর ইঞ্জিন ভ্যানের ড্রাইভার ট্রলি থেকে পরে গিয়ে সোজা ট্রাকের সামনের ডানদিকের চাকায়!
পাশ কাটিয়ে একটু এগিয়ে যাই। দেখি, বুনো মোড়লের মাথাটা কোলে নিয়ে একজন বসে আছে। বুনোদার কপালে, ভুরুর উপরে হালকা রক্তের দাগ আছে, আর নাক দিয়ে রক্ত বেড়িয়েছে। একটা পা এখনও ট্রাকের সামনের চাকার নিচে থাকলেও, বুনোদা বেঁচে আছেন। আশার আলো দেখতে পাই। সেই সময়ই একটা টর্চ জ্বলে ওঠে।
ট্রাকের নিচে অন্ধকারে যা বুঝতে পারিনি, তা দেখতে পেয়ে মনে হয়, এখনই হাসপাতালে না পাঠালে, শরীরে রক্তের অভাবে বুনোদা হয়তো মারা যেতে পারে।
বুঝতে পারি, দশটার ট্রেন স্টেশনে ঢোকার পর, যারা আশপাশের গ্রামে যাবে, তাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বুনোদা ফিরছিল। বুনোদা নিজের সাইড দিয়েই আসছিল। আর ট্রাকটা ........
দেখি, বুনোদা তখন কিছু একটা বলছে আর ডান হাত দিয়ে বুকে চেপে ধরতে চাইছে। কি বলছে তা আর শোনার চেষ্টা না করেই বাইরের দিকে বেড়িয়ে আসি।
আবার ট্রাকটার সামনে দিয়ে ঘুরে পিছনের দিকে এগিয়ে যাই। ততক্ষণে, একজন ট্রাকের ড্রাইভারের সিটে বসে দেখে নিয়েছে, ড্রাইভার এ্যাক্সিডেন্ট করার পর গাড়ি থামিয়ে চাবি নিয়ে পালিয়ে গেছে। কয়েকজন একবার ট্রাকটিকে ঠেলে পিছনে সরানোর বৃথা চেষ্টা করে। নড়াতেও না পেরে, রেগে গিয়ে সামনের কাঁচ ভেঙে দেয়।
আমি ট্রাকের পিছনের দিকে এগিয়ে যাই। ফোনটা বের করে রানাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করি। জানি ওর ফোন এখন ব্যস্ত থাকে। তবুও যদি পাওয়া যায়! যথারীতি এনগেজ টোন পাই। মানেটা সকলের জানা। যদি রানাকে পাওয়া যেত, তাহলে মাটি কাটার জে.সি.পি. গাড়িটা একবার আনিয়ে ট্রাকটিকে সরানো যেত।
পরপর দুবার রিং করার পর দেখি, দুটো বাইক এসে সামনে দাঁড়ায়। ওদের বাইক থেকে নামার আগেই অন্য জায়গায় পাঠাতে হবে। দেখি, একটি বাইকে সুদীপ ও অন্য বাইকটিতে যে এসেছে তার মুখ চেনা হলেও নাম জানি না। আমি এগিয়ে যাই। সুদীপকে বলি, একবার মাঠে গিয়ে মাটি কাটার জে.সি.পি.টা ডেকে আনতে পারবি। তাহলে হয়তো বুনোদাকে বাঁচানো যাবে।
এখুনি যাচ্ছি। তুমি রানাদাকে একবার ফোন করে দাও।
ওর ফোন ব্যস্ত। পরে বলে দেব। কোন অসুবিধা হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারিস গাড়িটাকে আনবি।
ততক্ষণে অন্য ছেলেটি বাইক থেকে নেমে আমার পাশেই দাঁড়িয়েছে। তাকে বলি, ভাই একবার হাইস্কুলের সামনে গিয়ে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনতে পারবে?
যাচ্ছি। বলেও ছেলেটি ট্রাকের দিকে এগিয়ে যায়। তাকে ছেড়ে দিয়ে নবকে ফোন লাগাই। সবুজ ভবনের এ্যাম্বুলেন্স নবই চালায়। পেয়েও যাই।
নব জানায় বাড়ি ফিরে এই সবে খেতে বসতে যাচ্ছিল। যাইহোক, খেয়েই আসছে, বেশি দেরি হবে না। কোথায় আসতে হবে বলে দিই।
ততক্ষণে ট্রাকের চারপাশে আরও ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন বেড়ে গেছে। বারবার চেষ্টা করেও ট্রাকটিকে নড়ানো যায়নি। একবার থানায় জানিয়ে দেওয়া দরকার। অন্তত পাঁচশো প্যাকেট আলু আছে এই গাড়িটায়।
থানার নম্বরে ফোন না করে, তাপসবাবুকে ফোন করি। তাপসবাবু থানারই একজন অফিসার, আবার তাপসের দাদা আমার ক্লাসমেট ছিল। সেই সুবাদে তাপসবাবুও আমায় দাদাই বলে।
হ্যাঁ দাদা, এতো রাতে? কোন খারাপ খবর আছে নাকি?
হ্যাঁ গো, আসলে আমাদের এখানে একটু আগে একটা এ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। পুরোটা জানাই।
যারা রাউণ্ডে আছে, তাদের জানিয়ে দিচ্ছি। কোন চিন্তা নেই, এখুনি পৌঁছে যাবে।
আমিও ফোন কেটে দিই। ততক্ষণে আর একটি বাইক এসে দাঁড়ায়। এই ছেলেটি সিভিক পুলিশের কাজ করে। ওকে তাপসবাবুকে ফোনের কথা বলি।
ও সাথে সাথেই আরও একজনকে ফোনে সবটা জানায়। এবং এ ও জানায়, প্রায় আশি একশো জন জমা হয়ে গেছে। ফোন কেটে যায়। বলে, সামনে পুলিশের গাড়ি এসে গেছে। আরও একটি গাড়ি থানা থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। ও এগিয়ে যায়।
হঠাৎ দেখি, ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে, সব আলু নামিয়ে ফেল। খালি হলে ট্রাকটিকে সরানো যাবে। কোন রকমে ওদেরকে, কয়েকজন থামায়।
এদিকে আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড গরমে দরদর করে ঘেমে চলেছি। অনেক দূরে জ্বলতে থাকা রাস্তার আলোগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। দূর থেকে রাস্তা দিয়ে কোন একটা বড় গাড়ি আসছে বলে মনে হয়। আমার চোখের সামনে থেকে সব কিছু যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে, আমি এখন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আর এই রাস্তা দিয়েই গাড়িটা আসছে।
কোন রকমে মনে বল এনে, শরীরটাকে রাস্তার মাঝ থেকে টেনে নিয়ে আসি। পাশে সিভিক পুলিশটির বাইক দাঁড় করানো আছে। সেটিতেই হেলান দিয়ে দাঁড়াই। আর সেন্সে থাকার চেষ্টা করি। প্রচণ্ড গরম লাগছে। মুখ জিভ যেন শুকিয়ে আসে। একটু জল খেতে পারলে ভালো হতো।
আবারও দূরের আলোর দিকে তাকাই। আমি যেটাকে বড় গাড়ি ভেবেছিলাম, আসলে সেটি মাটি কাটার জে.সি.পি. গাড়ি। এই ধরনের বুলডোজার গুলির প্রচুর ক্ষমতা। আমার পাশ দিয়ে যাবার সময়, দূর থেকে শোনার মতো শুনতে পাই, পিছনে না, সামনের দিকে যাও।
আর কিছু বুঝতে পারি না। আবার সব কিছু ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। শুধু বুঝতে পারি, আমি এখানে থাকলে, আমার জন্য হয়তো অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়তে পারে। তাই যতটা সম্ভব সেন্সে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু সামনের ট্রাকটিকেও দেখতে পাই না, সব কিছু যেন ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে।
চশমাটা খুলে হাত দিয়েই চোখ মুখের ঘাম মোছার চেষ্টা করি। ডানকানের সামনে দিয়ে একফোঁটা ঘাম মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাবির সামনেটা তুলে মুখটা আর একবার ভালো করে মুছে ফেলি। মাথাটাও ঘামে ভিজে গেছে। হাত দিয়ে চুল সরিয়ে হাওয়া ঢোকানোর চেষ্টা করি।
কিন্তু হাওয়া কোথায়! এবারে হয়তো পারবো। চেষ্টা করি সোজা হয়ে দাঁড়াতে। মাথাটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। তবুও বাড়ির দিকে ফেরার কথা ভাবি। হঠাৎই একজন আমার হাত ধরে আমাকে নাড়া দিয়ে বলে, একবার এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করোনা, বুনোদাকে বের করা হয়ে গেছে।
এক ঝটকায় সম্পূর্ণ সেন্স ফিরে আসে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই মনে পড়ে যায় সব কিছু। বলি নবদা এখুনি আসছে। ফোন করেছি। পারলে কাউকে একবার বাইকে পাঠিয়ে দে। বলতে বলতেই দেখি, এ্যাম্বুলেন্স ঢুকে পড়েছে। যে আমাকে নাড়া দিয়ে সেন্স এনে দিল, তাকে দেখার আগেই এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে সে'ও এগিয়ে যায় ট্রাকের সামনের দিকে।
আমার পাশে আর কেউ নেই। তবে ঝাপসা ভাবটা কেটে গেছে। প্রচণ্ড গরম হয়ে চলেছে। আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি। একটু এগিয়ে এসে শান্তনুকে ফোন করি। পুরোটা রিং হয়ে গেলেও, ফোন তোলে না। আমি একাই হেঁটে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাই।
বাড়িতে ঢুকেই ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিই। একটা জলের বোতল তুলে নিয়ে খানিকটা জল খাই। মা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
ও কিছু না। প্রচণ্ড গরম হচ্ছিল, তাই পাখা চালিয়ে ঠান্ডা হচ্ছি।
এখন খাবি, না আরও পরে খাবি?
একটু পরে খাচ্ছি।
পাখার নিচে খানিকক্ষণ বসার পর, বাথরুমে ঢুকি। অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শরীর ঠান্ডা করি। তারপর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসি। খাওয়া হয়ে গেলে, লাইব্রেরিতে ঢুকি।
পরদিন সকালে স্বাভাবিক নিয়মেই সকল কাজকর্ম চলতে থাকে। সন্ধ্যায় যখন শান্তনুর সাথে দেখা হয়, তখন জানতে পারি, বুলডোজার যখন ট্রাকের সামনেটা চাগিয়ে ধরে, তখন নিজেই পাটাকে বের করে আনে বুনোদা। এতোক্ষন ট্রাকের নিচে থাকলেও, একটা পা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেলেও, যন্ত্রণা হচ্ছিল না। কিন্তু পা বের করার পর থেকেই যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে পাঠানো গেছে।
কি হয় এবার? মনে হয় একটা পা বাদ দিতে হবে। একটা ইঞ্জিন ভ্যান চালিয়ে যেটুকু আয় করতো, তাও শেষ হয়ে গেল। শান্তনু রাতে থানাতেও গিয়েছিল। গাড়ির মালিকের সাথে কথা হয়েছে। থানা থেকেই ঠিক করে দিয়েছে, আপাতত ক্ষতিপূরণ বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা গাড়ির মালিক বুনোদার চিকিৎসার জন্য দেবে। আর গাড়ির ইন্সিওরেন্স থেকে এক লাখ টাকা পাওয়া যাবে।
আর যখন বুনোদা বুক পকেট চেপে ধরছিল, কারণ কালকের উপায় করা সব টাকাটা বুক পকেটেই ছিল। তাই ওটা যেন হারিয়ে না যায়!
এরপর আরও দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিনে কাজের চাপে কোন দিকেই মাথা দিতে পারিনি। আজকে আর কোন কাজ না থাকায়, ফেসবুকটা একবার খুলি।
হঠাৎ দেখি আমাকে ট্যাগ করা অনেক গুলি পোস্ট টাইমলাইনে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করছে। চেক করতে গিয়ে, সেদিন রাতের পোস্টটা পেয়ে যাই।
সবেমাত্র একটি লরি একটা ইঞ্জিন ভ্যানকে ধাক্কা মেরেছে। যে পোস্টটি দেখবে, সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসো। বলে একটা লোকেশন দেওয়া আছে। কিন্তু যে ট্যাগ করেছে, তাকে চিনতে পারি না। এখানে তার নাম সং-বাদ। তার প্রোফাইল পিকচার হিসাবে যা দেওয়া আছে, তা কোন মানুষের ছবিও না।
পরে আর একটি পোস্টে সং-বাদ সকলকে ধন্যবাদ দিয়েছে, আর জানিয়েছে, বুনো মোড়ল সুস্থ আছেন।
কিন্তু কে এই সং-বাদ? জানার চেষ্টা করি।
ম্যাসেজে, নাম জিজ্ঞাসা করি।
সাথে সাথেই রেসপন্স পাই।
স্যার, আমি সং-বাদ, প্রতি মুহূর্তে যা পুরানো হয়ে যায়।
এরপর আমিও শুধু একটি শব্দই লিখি, ধন্যবাদ।