স্কুল থেকে ফিরে বিপিনদের বৈঠকখানায় অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেওয়া প্রায় স্বভাবে পরিনত করে ফেলেছি। সন্ধ্যার পর থেকেই এক এক করে জড়ো হই। বেশিরভাগ দিন সন্ধ্যার টিফিনটাও ওখানেই হয়ে যায়। আসলে সারা দিন নানান কাজকর্মের পর সবাই মিলে একটু মজা করা আর কি! সবাই বলতে আমরা মোটে পাঁচজন। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে সংসার চালাই। তাই অভাবের সংসারে একটু সুখ বলতে এই আড্ডা।
আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াই। বিপিন জমিদার বাড়ির ছেলে হলেও, এখন আর জমিদারী নেই। একটা বই এর দোকান চালায়। সারা বছরের বেশিরভাগ সময় বেচাকেনা প্রায় হয়না। শুধুমাত্র বছরের শুরুতে কিছু বইখাতা বিক্রি হয়। রাজীব কয়েকটা পুকুরে মাছ চাষ করে। শান্তনু মাঠে চাষাবাদের কাজ করে এবং উৎপল একজন ডাক্তারবাবুর গাড়ি চালায়।
আমরা প্রত্যেকেই ছ'টা বাজতে না বাজতেই বৈঠকখানায় চলে আসি । আর এটা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত-----সব ঋতুতেই চলে। প্রতিদিনই মুড়ি, চানাচুর, ছোলা, শশা, কাঁচালঙ্কা, পিঁয়াজ সহযোগে টিফিনটা হয়। তবে গতকাল থেকে একটু অন্য রকম ঘটছে। প্রায় এক বছর পর, গতকাল আমি, বিপিন আর শান্তনু ছিলাম। প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির কারণে রাজীব আর উৎপল আসতে পারেনি।
আজও চারটে বাজতে না বাজতেই, আকাশ কালো মেঘে ঢেকেছে। আসলে বছরের এই সময়টাতে বাংলাদেশের সর্বত্রই কালবৈশাখী তার নিজস্ব তাণ্ডব চালায়। তবে সুখের কথা এই যে, কালবৈশাখী যেমন হঠাৎ আসে, তেমনি হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। মোটামুটি সারে চারটে থেকে শুরু হল ঝড়। বাড়িতে বসে বসেই ঝড়ের শোঁ শোঁ আওয়াজ পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের সাথে শুরু হল বৃষ্টি। সাথে মেঘের গর্জন, মনে ভয়ের সঞ্চার করে।
বাড়িতে একা বসে বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। আসলে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একা থাকলেই তেঁনারা চলে আসেন। আর কাগজেও অনেক খবরের মাঝে এই খবরটাই আমার চোখে পড়ল! হ্যাঁ- আসলে আমি এখন তেঁনাদের কথাই বলছি। তেঁনারা তাঁদের এক অদৃশ্য জাদুবলে অনেক কিছুই করতে পারেন। তেঁনারা শুধু যে অনেক কিছু করেন তাই না, তাঁদের অবাধ্য হলে মানুষের অনেক রকম ক্ষতিও করেন। আর সেই জন্যই খবরের কাগজে বেরোয়।
"হোটেলে রাতে অশরীরির উৎপাত" - এই শিরোনাম দেখেই চোখ আটকে গিয়েছিল। যাইহোক, খবরের পুরোটা পড়ে উঠে পড়লাম। এদিকে ঝড়বৃষ্টি যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কি আর করা যায়! প্যান্ট শার্টের উপর দিয়ে বর্ষাতিটা চাপিয়ে নিলাম। যদিও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী 'দাদুর ছাতা'টি নিতে ভুললাম না। খবরের কাগজটা সঙ্গে নিয়ে দরজায় চাবি দিলাম। এবারে আস্তে আস্তে বৈঠকখানার দিকে চললাম।
আসলে এটা আমার মামার বাড়ি। ছোটবেলায় এখানে থেকেই পড়াশোনা করেছি। স্কুলের পাঠ শেষ করার পর, মামার বাড়ি থেকে অনেক দূরে, নিজেদের বাড়িতে থেকে কলেজের পড়া শেষ করেছি। এই সময়ে দাদু ও দিদা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছেন। মামাদের সকলেও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে গেছেন। আর আমি একা স্কুলের চাকরিতে এসে ভিটে সামলাচ্ছি! তবু বিপিন, রাজীব, উৎপল, শান্তনুরা আছে বলে স্বস্তি।
বৈঠকখানায় যখন পৌঁছালাম, তখন ঝড়ের দাপট অনেক কমে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝেই বাজ পড়ে চলেছে। আর পাশেই কোথাও একটা পড়ায়, অন্ধকার কাটিয়ে দিয়ে চারিদিক আলোকিত করে তুলেছে। সেই আলোতেই দেখতে পেলাম, একটা কুকুর দরজার ঠিক সামনেই গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে। আমি কাছে আসতেই, এই বৃষ্টির মধ্যেও উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে শুরু করল। আমিও তার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।
দরজা ভেজানোই ছিল। একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। ঘরের ভিতরটা অন্ধকারে ভরে রয়েছে। কেউ আসেনি দেখে, রঘুদা হয়তো বাড়ির ভিতরে অন্য কাজ নিয়ে পড়েছে। আসলে এতো বড় বাড়িটায় একটা কোনের দিকের ঘরে বিপিন থাকে। পাশের একটি ঘরে রঘুদা থাকে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, রঘুদা জমিদার বাড়ির সব কাজ করে। বেশিরভাগ ঘর এখন বন্ধই থাকে। উত্তর দিকের কিছুটা অংশ অযত্নে ভেঙে পড়েছে। কয়েকটা বড় বড় বটগাছ তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে সমস্ত ভাঙা অংশ গুলোকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে রেখেছে। ওই দিকে দিনের বেলায়ও কেউ খুব একটা যায় না।
বৈঠকখানায় ঢুকে একপাশে ছাতা ও বর্ষাতি রাখলাম। অন্ধকারের মধ্যেই আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরের দিকে চললাম। এগিয়ে যেতে যেতেই রঘুদার নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকার পর, বিপরীত দিক থেকে 'যাই বাবু' বলে রঘুদার সেই পরিচিত আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখি একটা কালিপরা লণ্ঠন নিয়ে রঘুদা এগিয়ে আসছে। আমিও অন্ধকারে আর না এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রঘুদা এলে তার পিছনে পিছনে আবার বৈঠকখানায় ফিরে এলাম।
বৈঠকখানায় লন্ডনের আলো অন্ধকার দূর করার একটি কঠিন চেষ্টা করে চলেছে। বাইরে বৃষ্টির সাথে ঘরের আলো আঁধারি মিশে একটা ভৌতিক পরিবেশও প্রায় তৈরী হয়ে আছে। রঘুদাই জানালো, আজ দুপুরের পর বিপিন আর দোকানেও যায়নি। বাড়িতে লাইব্রেরীতে বসে বসে কি যেন পড়ছে। আর আজকে ডিসটার্ব করতে বারণ করেছে। ও নিজেই চলে আসবে। এটা শুনে আমিও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে ছ'টা বাজলো। এদিকে বৃষ্টি কমার কোন লক্ষণই নাই। বাইরে খুব কাছে কোথাও বাজ পড়ল। দেওয়ালে টাঙ্গানো বাইশনের মাথাটার দিকে চোখ পড়তেই কেমন যেন শিউরে উঠলাম। ঠিক দেখলাম! না কি চোখের ভুল! বাইশনের চোখগুলো থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। চমক কাটিয়ে, লণ্ঠনটি তুলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠিক যেখানে বাইশনের মাথাটি আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে লণ্ঠনটি উঠিয়ে ধরলাম। নাঃ! প্রতিদিনের মতোই, কোন নতুন কিছু নয়। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর জন্য আলো আঁধারিতে ভুল দেখেছিলাম।
কি দেখছেন দাদাবাবু? এই বাইশনটিকে বড় দাদাবাবু যখন গুলি করে মারেন, তখন আমি আর পঞ্চা বড় দাদাবাবুর সাথেই ছিলাম। আমরা তিনজনে উত্তর দিকের মাচায়, আর মেজ দাদাবাবু, দারোগাবাবু আর ডাক্তারবাবু দক্ষিণ দিকের মাচায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাচার উপর বসে বসে অপেক্ষা করা! দুপুরের পরে তো, বড় দাদাবাবু শিকারের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। আর বারবার পঞ্চাকে বলছিলেন, "ঠিক ভালো করে লক্ষ্য করেছিলি তো!" পঞ্চাও 'হ্যাঁ কত্তা,' বলে সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ ক্ষুরের শব্দ শোনা যেতে লাগল। বড় দাদাবাবু আর পঞ্চা বন্দুক হাতে নিয়ে নিঃশব্দে ওৎ পেতে থাকলো। আমি দক্ষিণ দিকের মাচায় দেখি, তারাও সবাই অপেক্ষায়।
সব কিছুর শেষে, তাদের দেখতে পাওয়া গেল। একসাথে প্রায় একশো কি তারও বেশি হবে। এই বাইশনটাই ওদের রাজা ছিল। সবার আগে ও-ই জল খাওয়ার জন্য নদীতে নামলো। বড় দাদাবাবুর বন্দুক গর্জে উঠলো। অব্যর্থ লক্ষ্য। কিন্তু একটা গুলি খেয়ে বাইশনটা রেগে লাফিয়ে উঠল। সোজা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে লাগল। পঞ্চা ততক্ষণে আর একটি বন্দুক বড় দাদাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে, আগের বন্দুকটি পরিষ্কার করতে শুরু করে দিয়েছে। উল্টো দিকের মাচা থেকেও বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। চারটে গুলি খেয়েও এগিয়ে আসছিল। বড় দাদাবাবুও বন্দুক তাক করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক একটা মুহুর্তও অনেক বড় বলে মনে হচ্ছিল। শেষে সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে বড় দাদাবাবু একেবারে বাইশনটির মাথায় গুলি করলেন। আর বাইশনটাও লুটিয়ে পড়ল। ততক্ষণে অন্য সব বাইশনেরা যে যেদিকে পেরেছে ভেগেছে। তাঁবুতে খবর দিতে, সবাই গিয়ে বাইশনটিকে তাঁবুতে নিয়ে এলো। ডাক্তারবাবু বাইশনটির উপর পা দিয়ে ছবি তোলালেন। ওই যে কপালের কাছে, কালো মতো দাগটা দেখছেন, ওইখানেই শেষ গুলিটা লেগেছিল।
আমি এতোক্ষন রঘুদার কাছ থেকে বাইশনটার বীরত্বের কাহিনী মন দিয়ে শুনছিলাম। রঘুদা কি সুন্দর ভাবে সবকিছু গুছিয়ে বলে গেলেন। কতদিনের পুরানো কথা! এমন ভাবে বললেন, যেন এই সেদিন ঘটেছিল। আসলে শিকারের মজাই হয়তো এমন! তবুও বাইশনটার বীরত্বের কথা শুনতে, ভালো লাগছিল। রঘুদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি প্রতিবারই শিকারে যেতে?
না গো, আমায় মোটে দু'বার নিয়ে গিয়েছিল। একবার এই বাইশনটা মেরেছিল। সেবার অনেক গুলো খরগোশও শিকার করা হয়েছিল। আর একবার একটা চিতাবাঘ মেরেছিল। কিন্তু সেবারে আমি শুধু তাঁবুতেই ছিলাম। আর তাঁবুর ভিতরের কাজ করতাম। তবে চিতাটাকে যখন তাঁবুতে নিয়ে এল, তখন দেখেছিলাম। ইয়া বড় বড় পাঞ্জা! কি বিশাল তার শরীর! তবে হ্যাঁ, পঞ্চাকে বড় দাদাবাবু প্রতিবার শিকারে নিয়ে যেতেন। পঞ্চাও শিকারের সময় বড় দাদাবাবুর সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতো। বড় দাদাবাবু যখন সগ্গে গেলেন, তার কিছুদিন পর, পঞ্চাও চলে গেল! আস্তে আস্তে সবাই কলকাতায় চলে গেল! আমি আর ছোটবাবুই এখন আছি। আমার আর ক'দিন! আপনারা ছোটবাবুর একটা বিয়ে দেন দিকি।
আচ্ছা, সে না হয় হবেক্ষণ। তার আগে এখন একটু ভালো করে চা বানাও দিকি। বলতে বলতে বিপিন ঘরে ঢুকলো। জানিস সৌরভ, আজ মনে হয় আর কেউ আসবে না। যা বৃষ্টি নেমেছে, তাড়াতাড়ি থামবে বলে তো মনেও হয় না।
এদিকে রঘুদাও আস্তে আস্তে ভিতরের দিকে চলে গেল। আমি আজকের খবরের কাগজটি বের করে, খবরটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালাম।
বিপিন বলল, কই! দেখি, কি লিখেছে?
এতটা উৎসাহ! কারণটা কিন্তু অশরীরি না, এখানে যে হোটেলটির কথা বলা হয়েছে, সেটি একসময় বিপিনদের খামারবাড়ি ছিল। এখন একজন ভাড়ায় নিয়ে ট্যুরিজম ব্যবসা করছে। তাই নিজেদের খামারবাড়ি সম্পর্কে উৎসাহ থাকাই স্বাভাবিক। গভীর রাতে কারা যেন ছাদের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছে! তাদের ভারি পায়ের আওয়াজ, নীচ থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ছাদের উপরে ওঠার রাস্তা নীচ থেকেই বন্ধ। এটা অশরীরি ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে!
বিপিন বলল, আজ দুপুরে খামারবাড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছে। আর সেই জন্যই কি করা যায়, এখনই ভাবতে হচ্ছে। যদি ভূতের উপদ্রব চলতে থাকে, তবে কেউই আর ওখানে যেতে চাইবে না। ফলে যারা ব্যবসা করছে, তারাও ব্যবসা গোটাবে। বিপিন ভাড়া বাবদ যেটুকু পেত, তাও বন্ধ হয়ে যাবে!
হঠাৎই বিপিনকে বললাম, এখান থেকে তো খামারবাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। চল না, আজ রাতে একবার ঘুরে দেখে আসি। বিপিনও যেন এই কথাটাই বলতে চাইছিল। ততক্ষণে রঘুদা একটি থালায় করে মুড়ি ও পিঁয়াজি নিয়ে হাজির। বলল, এগুলো শেষ হলে চা দেবেন। মুড়ি খেতে খেতেই আমরা ঠিক করলাম, আজ রাতে রঘুদার রান্না করা খিচুড়ি আর পিঁয়াজি খাওয়ার পর রঘুদাকে বাড়িতে রেখে, আমি আর বিপিন কাউকে না জানিয়ে খামারবাড়ির পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকবো। কোথাও কিছু দেখতে পেলে, যেমনটি দেখবো তেমনটি ব্যবস্থা হবে।
যদি আর কেউ এসে পৌঁছায়, এবং আমাদের সাথে সঙ্গ দিতে চায়, আমরা রাজি। ঢং করে ঘড়ি সারে ছ'টা জানান দিল। হঠাৎ দেখলাম, দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। এই তো, ছাতা মাথায় উৎপল হাজির। আমাদের কিছু বলার আগেই, একটি পিঁয়াজি তুলে তাতে কামড় বসিয়ে বলে, এই বৃষ্টিতে রঘুদাকে বলে খিচুড়ির ব্যবস্থা কর। বুঝতে পারি, সবাই ক্রমশ একই পথেই হাঁটছি।
কিছুক্ষণ পরেই শান্তনু হাজির। তবে বোধ হয়, বৃষ্টি আটকানোর জন্য কিছুই পায়নি। একেবারে কাকভেজা হয়ে ঘরে ঢুকেছে। দেখি, রঘুদা বিপিনের একজোড়া পায়জামা ও ফতুয়া নিয়ে শান্তনুকে দিয়েছে। আজ মনে হয় জমবে ভালো! শুধু ঐ খামারবাড়ির মাঝরাতের অতিথিই একটু অস্বস্তিতে ফেলছে।
বাইরের বৃষ্টির সাথে আবার ঝোড়ো বাতাস নতুন করে যোগ হল। সাধারণত কালবৈশাখী থেমে যাবার পর সেদিন আর কিছু হয় না। কিন্তু আজ যেন একটু অন্য কথা বলছে। দেখি কতক্ষন চলে! এই সব কিছুর মাঝে আমাদের আড্ডাও চলছে।
হঠাৎই শান্তনু বলল, আজ ঝড় বৃষ্টিতে পড়ে যা অবস্থা হল, তাতে হাত পা যেন হিম মেরে গেছে। মনে চাঙ্গা হতে হলে, একটা এমন কিছু দরকার যাতে উদ্দীপনা বাড়ে।
উৎপল বলে, তবে বিপিন বরং একটা ভূতের গল্প বল। বিপিন বলে, এইভাবে কি আর ভূত আসে! ভূতের যখন সময় হয়, তখন নিজে নিজেই চলে আসে। যাইহোক, বহুদিন আগেকার কথা। তখন সবেমাত্র মাধ্যমিক দিয়েছি। সৌরভ, তোর মনে আছে? তুই, আমি, শামিম, সবাই রাতে নাইটগার্ড দিতাম।
হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না। সেই সময় কতো কি হয়েছিল। কতবার ভূত ভেবে, শুধু শুধু ভয়ে মরেছি।
তা হয়েছে কি, একদিন রাতে, রাত্রি তখন দেড়টা, কি দুটো হবে। শামিম আর আমি একসাথে রয়েছি। একটা মোড়ে, যেই না বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছে, কোথা থেকে দুটো অচেনা কুকুর এসে চিৎকার শুরু করল। আমি আর শামিম শেষে বাধ্য হয়ে ঢিল ছোঁড়ার মতো অঙ্গভঙ্গি শুরু করি। কিছুটা সময় পর, কুকুর দুটো অন্য দিকে সরে যায়। আমরাও আস্তে আস্তে খামারবাড়ির দিকে এগোতে থাকি। কিন্তু, এতো রাতে ওটা কি? একটা বাছুর দেখলাম বলে মনে হল! লাফাতে লাফাতে আমাদের সামনেই রাস্তাটা পার করে ঐ ঝোপের পিছনে চলে গেল!
শামিম তো আমায় বলেই ফেলল, কি রে, আজ মনে হয় তোদের সব গরু বাছুর খামারে ঢোকেনি!
তাই তো দেখছি! চলতো, খামারে কে আছে, একটু বলে দিই। এই বলে আমি আর শামিম খামারবাড়ির দরজায় ধাক্কা দিই। ভিতর থেকে নিমাইকাকা 'কে' বলে একটা চিৎকার করেন। আমাদের কথা শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে, ভিতরে বসতে বলেন। এবং একটি লণ্ঠন তুলে নিয়ে গোয়ালচালার দিকে এগিয়ে যান।
কিছুক্ষণ পরেই ফিরে আসেন। বলে, দাদাবাবু, এই বুড়ো বয়সে একটা কথা বলি কি! আপনারা আজকে আর ওদিকে যাবেন না। ওটা একটা গো-ভূত! একদিন আমি সারারাত ওকে ধরার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি। কিন্তু, সব সময়ই ও আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকে। আমি যেদিকে যতখুশি এগোই না কেন, সব সময়ই সামনের দিকে, আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকে। শেষে নাকানি চোবানি খেয়ে, সারারাত জেগে এদিক ওদিক ঘুরে, সকালে দেখি, গোয়ালে সবকটি গরু বাছুর সংখ্যায় একই আছে। আমি এখনই গোয়ালে গিয়ে দেখে এলাম, সবাই ভিতরেই আছে। দাদাবাবু, আজ আপনারা বাড়ি ফিরে যান।
যাইহোক, সব শুনে, আমি আর শামিম আবার রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শামিম বলল, একবার চেষ্টা করে দেখবি নাকি! আমার চোখেও তখন একই ছবি ঘুরছে। তাই উত্তরের বিনা প্রয়োজনেই আমরা ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চাঁদের আলোয় সবকিছুই দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। তাই আমাদের কাছে টর্চ থাকলেও, জ্বালছিলাম না। ডানদিক দিয়ে ঝোপের কাছে এগিয়ে চলেছি।
নাঃ! কোন কিছু নেই। এবারে শামিম টর্চ জ্বালালো। জোড়ালো আলোতে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে উঠল। মাটির উপর পড়ে থাকা প্রতিটি শুকনো পাতা এবং দুব্বোঘাস দেখা গেলেও, বাছুরের দেখা পাওয়া গেল না। কোন দিকে যেতে পারে, চিন্তা করতে থাকি। এমন সময়ে, আমাদের কাছ থেকে প্রায় একশো গজ মতো দূরে হবে। খামারবাড়ির পাঁচিলের পাশে তাকে লাফাতে দেখা গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা সতর্ক হয়ে উঠলাম। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে, প্রায় নিঃশব্দে রাস্তার দিকে এগিয়ে চললাম। দূর থেকে দেখতে দেখতে রাস্তাটা পার করে খামারবাড়ির পাঁচিলের পাশ ধরে এগিয়ে চলেছি। আমরাও যতই এগোতে থাকি, বাছুরটিও ততই দূরে এগিয়ে চলে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লে, লাফাতে লাফাতে আমাদের কাছে এগিয়েও আসে। কিন্তু সবসময়ই একটা দূরত্ব বজায় রাখে!
ঠিক দিনের বেলায় কোন একটা বাছুর যেভাবে ছুটে বেড়ায়, এই বাছুরটিও একইরকম আচরণ করছে। লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যায়, আবার পরক্ষণেই লাফাতে লাফাতে পিছিয়ে আসে। আমরা হাত বাড়ালেও, ধরা দেয় না। এযেন একটা মজার খেলা। আমরা দু'জনেও একই ভাবে এই খেলায় মেতে রয়েছি। বাছুরটি ও আমাদের মাঝের দূরত্ব এখন অনেক কমে এসেছে। আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে বাছুরটা তাকিয়ে রয়েছে।
আমি একেবারে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। মনে হয়, আমার পাদুটোকে কেউ যেন আঠা দিয়ে মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে। আমার হাত গুলোও কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। আমি কি বাছুরটাকে ধরবো! আমিই এখন আর আমার বশে নেই। চুপচাপ পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে বাছুরটির দিকে তাকিয়ে রয়েছি। তার চোখে কি আছে জানিনা, যেন সবকিছু অবশ করে দেয়, মোহময় করে তোলে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি। শামিম আস্তে আস্তে বাছুরটির দিকে এগিয়ে চলেছে। বাছুরটিও শামিমকে এখন কাছে আসতে দিচ্ছে। শামিমের থেকে বাছুরটার দূরত্ব বড়জোড় পাঁচ হাত। আমার যেন তর সইছে না। এক একটা মুহুর্তও কি বিশাল, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু, এটা কি হল! শামিম আর এগোচ্ছে না কেন? কি যে করি? একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ সবকিছু যেন থমকে গেছে। এতো নিশ্চুপ অবস্থায়, আগে কখনও পড়িনি। বুঝতে পারছি না। সবকিছুই যেন স্টিল ছবির মতো আটকে গেছে। শুধু আমার গায়ে একটা হিমশীতল হাওয়ার পরশ লাগছে। যা তখন বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আমি জীবন্ত পৃথিবীর অংশ। কিন্তু সেই বরফের মতো হাওয়ার স্পর্শ আমার শরীরকে ক্রমশ শীতল করে তুলছিল। আর পারছি না! চোখের সামনের ছবিগুলো কেমন যেন আবছা হয়ে যাচ্ছে!
এরপর কি হয়েছিল, আর মনে নাই। পরদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে, শামিমের থেকে শুনেছিলাম অন্য একটি গল্প!
আগের রাতে আমরা দুজনে যখন দ্বিতীয় বারের জন্য বাছুরটিকে দেখি, তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাছুরটার পিছনে ছোটাছুটি করার পর, যখন বুঝে যাই, নিমাইকাকার কথাই হয়তো সত্যি! তাই পিছন ফেরা শুরু করি। আর তখনই বাছুরটিও আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। তখন আমাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, শামিম উল্টো দিক দিয়ে বাছু্রটার দিকে এগিয়ে যায়। খুব সন্তর্পণে, ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়। শামিম যতই বাছুরটির দিকেএগোতে থাকে, বাছুরটিও ততই আমার দিকে সরে আসে। শেষে শামিম চিৎকার করে আমায় বাছুরটাকে ধরতে বলে। আমি কিন্তু তখন বাছুরটাকে না ধরে, তার গায়ে-মাথায়, গলায় হাত বোলাচ্ছিলাম। বাছুরটিও আমার হাতের স্পর্শ খুব ভালোভাবেই উপভোগ করছিল। এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল। শামিমও এগিয়ে আসে। বাছুরটার গায়ে হাত দিয়েই চিৎকার করে ওঠে।
আর বাছুরটাও একলাফে আমাদের কাছ থেকে সরে যায়। আমিও সেই লাফ সহ্য করতে না পেরে পড়ে যাই। পরে সবাই মিলে ধরাধরি করে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে। আর শামিম জানায়, বাছুরটার শরীর নাকি বরফের মতো ঠান্ডা ছিল।
এদিকে রঘুদা তাড়া দিতে শুরু করেছে। বলে, বাবু রাত যে নটা ছাড়িয়ে গেছে। আর খিচুড়িও তৈরী। তাই আর সময় নষ্ট না করে যেন তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিই।
আমরাও আর দেরি না করে বসে পড়লাম। বৃষ্টি বাদলার মধ্যে, ভূতের গল্পের পরে খিচুড়ি আর পিঁয়াজি, বেশ জমল ভালো। খাওয়া শেষ করে কয়েকটি সুপারির টুকরো মুখে ফেলে বিপিন বলে, 'তাহলে সৌরভ আর আমি আজ রাতে খামারবাড়িতে যাব'। একথা শুনেই উৎপল ও শান্তনুও যেতে চায়। ঠিক হয়, আমি বিপিনদের বাড়িতেই থেকে যাচ্ছি। উৎপল ও শান্তনু এখন বাড়ি ফিরলেও রাত্রি সারে এগারোটার মধ্যে বৈঠকখানায় এলেই হবে। সেইমতো উৎপল ও শান্তনু বেড়িয়ে যায়।
এদিকে বৃষ্টিও থেমে গেছে। বিপিন তার লাইব্রেরিতে ঢুকেছে। আমি আর কি করি! বৈঠকখানায় যে তক্তাবোশটি আছে, তার উপরে একটু গড়িয়ে নিচ্ছি। বাইরে বিকেল থেকে ঝড়বৃষ্টির কারণে এই আষাঢ়েও গরম বুঝতে পারছি না। তাই শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঝিমুনি গ্রাস করল। এদিকে আমি এমনভাবে শুয়েছি যে চোখ খুললেই সোজা সামনের দিকে বাইশনের মুখটা রয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লেও মনের মধ্যে বাইশন ও বাছুরটা রয়েই গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙলো বিপিনের ডাকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি, উৎপল আর শান্তনুও এসে গেছে। আমরা চারজনে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে পরি। বিপিনদের বাড়ি থেকে খামারবাড়ি যেতে প্রায় একঘণ্টা হাঁটতে হবে। আমাদের চারজনের কাছে শুধু একটি করে টর্চ আছে। আত্মরক্ষার জন্যও আর কিছু নেই। তবে আমার কাছে আমার ছাতাটি আছে। বর্ষাতিটা বৈঠকখানাতেই রেখে এসেছি। আমরা এগিয়ে চলেছি।
কেন যে গ্রামাঞ্চলের রাস্তা সোজা হয় না! আমরাও রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছি। নিজেদের জুতোর শব্দ ছাড়া,আর কোন শব্দ নেই। অনেকক্ষণ আগেই বৃষ্টি থেমে যাওয়ায়, এখন আকাশ বেশ পরিষ্কার। আকাশে চাঁদও রয়েছে। তবে একফালি চাঁদ হওয়ায়, তার জৌলুশ কম। সাথে তারাদের আলোও পূর্ণতা এনে দিতে পারেনি। হঠাৎ শান্তনু বলে, এবার টর্চ অফ করে চলা অভ্যাস করে নে। না হলে, আমাদের টর্চের আলো দেখে অন্যরা আমাদের বুঝে ফেলতে পারে।
তাই আমরাও টর্চ নিভিয়ে দিই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই আমাদের চোখ সয়ে আসে। আমরাও আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকি। ঐ যে, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে খামারবাড়ির পাঁচিল। কিন্তু হোটেলটি আছে ঠিক বিপরীত দিকের কোনে। এখান থেকে আমরা রাস্তা ছেড়ে দিই। খামারবাড়ির পাঁচিলের পাশ দিয়ে পূর্বদিকে মাঠের দিকে নেমে যাই। মাঠের উপর দিয়েই এগিয়ে চলি। পাঁচিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার জন্য, দূর থেকে আমাদের দেখতে পাওয়া যাবে না। তার উপরে পাঁচিলের ছায়াও এই দিকেই পড়েছে।
আমরা একেবারে পাঁচিলের শেষপ্রান্তে এসে গেছি। এরপরই আমাদের উত্তর দিকে বাঁকতে হবে। যেখানে কোন পাঁচিল নেই। তবে বাশ ও লোহার জাল দিয়ে ঘেরা আছে। আর জালের ভিতরের দিকে বড় বড় ফলের গাছ অন্ধকার করে রেখেছে। তাই এই পথে আমাদের দেখতে পাওয়া অসম্ভব। তবুও অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছি। দূর থেকে হোটেলের বৈদ্যুতিক আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। যেখানে আমাদের দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমরা সব কিছু দেখতে পাব। এখান থেকে ছাদে ওঠার লোহার ঘোরানো সিঁড়িটি পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একফালি আলো সিঁড়িটার উপর পড়ায়, আরও সুবিধা হয়েছে। আমরা কোন কথা না বলে, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কোথা থেকে দলে দলে মশারা এসে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সারা শরীরে হুল ফুটিয়ে চললেও আওয়াজ করতে পারছি না। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি। অনেকক্ষণ এইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, বিপিনই বলল, আজ আর মনে হয় কিছু হবে না। আবারও সব চুপচাপ।
হঠাৎ শান্তনু কিছু একটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখায়। দেখি, অন্ধকার থেকে সিঁড়ির দিকে একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। আমরা চারজনেই সতর্ক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দূর থেকে ঠিক মতো বোঝা না গেলেও, এখানে যে তেঁনারা নেই, বুঝতে পারলাম। কেউ হয়তো খামারবাড়িকে অসদ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।
এই রে! আমার নাকটা যে শুড়শুড় করতে শুরু করেছে। নাঃ! আর চেপে রাখতে পারছি না!
হ্যাঁচ্-ছো!
নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। আমার হাচির আওয়াজ শুনে ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়েছে। হাচিও আর সময় পেল না। এই হাচিই আমাদের একটি সমস্যা সমাধান থেকে পিছিয়ে দিল। কি আর করা যায় - আমরাও বাড়ির পথ ধরলাম।
তবে এই ঘটনার পর থেকে খামারবাড়িতে, মানে বর্তমানের হোটেলে, আর কোন উৎপাত হতে দেখা যায়নি। সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে।