Shafiqul Islam's life and literary works in Bengali Biography by Shafiqul Islam books and stories PDF | শফিকুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য কর্ম

Featured Books
Categories
Share

শফিকুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য কর্ম

শফিকুল ইসলামের

জীবন ও সাহিত্য কর্ম

সম্পাদনাঃ ডঃ সৈয়দ এস আর কাশফি

সূচীপত্র

১।কবি শফিকুল ইসলামের জীবনী

২। কবির দুটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকার

১।কবি শফিকুল ইসলাম যাকে সব সময় মনের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায়...

২।কবিতার মাঝে জীবনবোধকে ফুটিয়ে তোলা কবি শফিকুল ইসলামের নিরন্তর সাধনা

৩।কবিকে যেমন দেখেছি

৪।কবি রচিত বইসমূহের তালিকা

৫।কবির কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র

৬। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সনদ ও মানপত্র

৭।বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রাপ্ত পুরষ্কারের ছবি

কবি শফিকুল ইসলামের জীবনী

উদভ্রান্ত যুগের শুদ্ধতম কবি শফিকুল ইসলাম। তারুণ্য ও দ্রোহের প্রতীক । তার কাব্যচর্চ্চার বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি অনেক গান ও রচনা করেছেন। তার দেশাত্ববোধক ও সমাজ-সচেতন গানে বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার।

শফিকুল ইসলামের পৈতৃক আদিনিবাস বাংলাদেশের সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দি গ্রামে। চাকরীসূ্ত্রে তার বাবা শহরের শেখঘাটস্থ খুলিয়াপাড়ায় ভাড়া বাসায় চলে আসেন।সেখানেই শফিকুল ইসলামের জন্ম ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৩ সালে।

শফিকুল ইসলামের পিতার নাম মনতাজ আলী। তিনি পেশায় একজন কাষ্টমস অফিসার ছিলেন। তার মাতার নাম শামসুন নাহার। ছাত্রাবস্থায় তিনি তার পিতামাতা উভয়কে হারান।এরপর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।শত প্রতিকুলতা সত্ত্বেও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের পথে কিছু বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি আজন্ম উচ্চাভিলাষী শফিকুল ইসলামের যাত্রাপথে।

শফিকুল ইসলাম সিলেট জেলার এইডেড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি ও মদন মোহন মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে এইচএসসি ও ১৯৮২ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।এরপর ১৯৮৩ সালে তিনি জগন্নাথ বিশ্বিবদ্যালয় কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মাস্টার্স পড়াকালীন নারায়নগঞ্জের ১২৪, বঙ্গবন্ধু রোডে থাকতেন। সেখান থেকেই বাসে বুড়ীগঙ্গার তীর ঘেষা সড়ক ধরে পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে যাওয়া আসা করতেন। নারায়নগঞ্জের ১২৪, বঙ্গবন্ধু রোডে অবস্থানকালীন প্রেক্ষাপটে তার সুলতা নামে অমর কাব্য চরিত্রের সৃষ্টি করেন।

২০০৪ সালে ব্যারিষ্টার হওয়ার লক্ষ্যে তিনি লণ্ডন ইউনিভার্সিটিতে এলএলবি(অনার্স)কোর্সে ভর্তি হন।কৃতিত্বের সাথে এলএলবি(অনার্স)প্রথম বর্ষ উত্তীর্ণ হলেও আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে তার বার-এট-ল ডিগ্রী অর্জন সম্ভব হয়নি।তিনি ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে সমাজকল্যাণে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। তার আগে ২০০৮ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে এম,এ ইন ইসলামিক ষ্টাডিজ ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শিক্ষাজীবনে অনন্য কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।

কর্মজীবনে একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা কবি শফিকুল ইসলাম চাকরীসূত্রে বিসিএস(প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য। তার কর্মজীবনের শুরু কুষ্টিয়া ডিসি অফিসে সহকারী কমিশনার হিসেবে।এছাড়া রাজবাড়ী, শরীয়তপুর এবং কিশোরগঞ্জ ডিসি অফিসে সহকারী কমিশনার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলা, মৌলভীবাজারের সদর উপজেলা, চট্টগ্রামের বাশখালী উপজেলায় সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জে সহকারী কমিশনার(ভূমি), ভোলার মনপুরায় উপজেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, ঢাকার প্রাক্তন মেট্রোপলিটান ম্যাজিষ্ট্রেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাবেক এডিসি। এছাড়া ও তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরে উপপরিচালক ছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডিতে উপসচিব পদে ও বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন। বর্তমানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে কর্মরত।তিনি সরকারী কাজে যে সব দেশ ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বৃটেন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুর।

আজন্ম মানবদরদী নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ শফিকুল ইসলাম শৈশব থেকে দুস্থ জনগণের সেবায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। সুযোগ পেলেই তাদের কাছে ছুটে যেতেন এবং নানাভাবে তাদের সাহায্য করতেন এবং সে ধারা এখনও অব্যাহত রেখেছেন।

লেখালেখির শুরু ছাত্রজীবনে স্কুল ম্যাগাজিনে লেখালেখির প্রচেষ্টা থেকে। সেটি ছিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ। তখন কবি ক্লাস সেভেনে পড়েন।কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৮০সালে সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদের উন্মুক্ত চত্বরে কবিতা পাঠের মাধ্যমে প্রথম জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ।মদন মোহন কলেজে পড়াকালিন তার সম্পাদনায় ‘স্পন্দন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের হয়। আর সেই ম্যাগাজিনে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।এরপর কলেজ ম্যাগাজিনে তার লেখা কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। চাকরীসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মকালীন সময়ে তার কবিতা ও গান বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।পরবর্তীতে স্থানীয়, জাতীয় ও অনলাইন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা এবং ইবুক পাবলিশিং ওয়েব সাইটে ও বিভিন্ন ফোরামে তার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

ছা্ত্রজীবনে ১৯৮১সালে তৎকালীন ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে দেশব্যাপী আয়োজিত সাহিত্য প্রতিযোগীতায় শীর্ষস্থান লাভ করে বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে লেখক সম্মাননা পদক ২০০৮প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নজরুল স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন।হন।(মোবাইল ফোনে google play store এর সার্চবক্সে Tobuo Bristi Asuk/‘তবুও বৃষ্টি আসুক’ লিখে search দিয়ে বইটি ডাউনলোড করা যাবে)। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক নানা পদকে ভূষিত হন।

আপাতদৃষ্টিতে তাকে অনেকে প্রেম ও বিরহের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করলে ও তিনি যে একজন সমাজ-সচেতন কবি তা তার দহন কালের কাব্য ও প্রত্যয়ী যাত্রা কাব্যগ্রন্থ পাঠে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও বৈষম্য যে তাকে সংক্ষুব্ধ করেছে, অনায়াসে তা উপলব্ধি করা যায়।

সাধারণ কবিদের মত তিনি ভাববিলাসিতায় ভেসে যাননি। ভাবের গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে অবলুপ্ত করে দেননি। প্রকৃত কবির মত তার কবিতায় কাব্যিক মেসেজ অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে কি সে মেসেজ? তার কাব্য সৃষ্টিতে সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার নিগূঢ় দর্শন অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত প্রবহমান। তার ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় কবি বলেছেনঃ-

“তারও আগে বৃষ্টি নামুক আমাদের বিবেকের মরুভূমিতে,সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক-আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা, হৃদয়ের গ্লানি…”(কবিতাঃ ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’)

পংক্তিগুলো পাঠ করে নিজের অজান্তে আমি চমকে উঠি। এতো মানবতাহীন এই হিংস্র পৃথিবীতে বিশ্ব মানবের অব্যক্ত আকাংখা যা কবির লেখনীতে প্রোজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়েছে। এ তো শুধু কবির কথা নয়, এ তো একজন মহামানবের উদ্দীপ্ত আহ্বান। তার কবিতা পাঠে আমি অন্তরের অন্তঃস্থলে যেন একজন মহামানবের পদধ্বনি শুনতে পাই। যিনি যুগ মানবের অন্তরের অপ্রকাশিত আকাংখা উপলব্ধি করতে পারেন অনায়াসে আপন অন্তরের দর্পণে। তাই তিনি বিশ্ব মানবের কবি। বিশ্বমানবতার কবি।

তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ ঃ বিভিন্ন সময়ে একুশে বইমেলায় তার কাব্যগ্রস্থ প্রকাশিত হয়।তার প্রথম প্রকাশিত বই ‘এই ঘর এই লোকালয়’ প্রকাশিত হয় ২০০০সালে প্রবর্তন প্রকাশন থেকে । একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় আমীর প্রকাশন থেকে। তবু ও বৃষ্টি আসুক ২০০৭ সালে ও শ্রাবণ দিনের কাব্য ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় আগামী প্রকাশনী থেকে । দহন কালের কাব্য ২০১১সালে ও প্রত্যয়ী যাত্রা ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় মিজান পাবলিশার্স থেকে। গীতি সংকলন ঃ মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে। এছাড়া রয়েছে আড়াই হাজারের অধিক গান নিয়ে ‘শফিকুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা’ নামের পাচ খণ্ড বিশিষ্ট গ্র্ন্থ। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন লেখক, সাহিত্যিক. অধ্যাপক, আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক তার রচিত সাহিত্যকর্মের উপর আলোচনা ও গবেষণা করেছেন।

বর্তমানে kaljoyee.com, ডিজিটাললাইব্রেরি.বাংলা, , sheiboi.com, , bengaleboi.com এবং www.eakash.com সহ বিভিন্ন ওয়েব সাইট থেকে এবং banglapdf.net, www.boighar.com, kazirhut.com, www.boilovers.com ও www.boierdunia.in সহ বিভিন্ন ফোরাম থেকে তার রচিত বইসমূহ ডাউনলোড করা যায়।এছাড়া গুগোল প্লে-ষ্টোরে রয়েছে তার বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার, যা তাৎক্ষণিকভাবে ডাউলোড করে পাঠ করা যায়। ফেসবুক গ্রুপ এবং ইউটিউবেও রয়েছে তার রচিত কবিতা আবৃত্তি ও গানের অসংখ্য ভিডিও। বর্তমানে থেকে অনলাইনেঅনলাইনে(Help: 16297 অথবা 01519521971 ফোন নাম্বারে) সরাসরি তার সকল বই সংগ্রহ করা যায়।

-- লেখক: সাংবাদিক নিজাম ইসলাম

কবির দুটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকার

কবি শফিকুল ইসলাম যাকে সব সময় মনের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায়...

আউলিয়া বেগম আলো (সম্পাদক, জাতির আলো)ঃ মহান সাধক ব্যক্তিরা বলে গেছেন পৃথিবীতে এসেছিস একটি দাগ রেখে যা। আসলি আর গেলি এমনটি যেন না হয়। তাই তো বিজ্ঞ জ্ঞানী গুণী ও সচেতন ব্যক্তিবর্গ আসা-যাওয়ার এই দুনিয়ায় কিছু না কিছু রেখে যতে চান। তবে কর্মে একনিষ্ঠ, দায়িত্ববোধ, সঠিক সাধনা ও সাফল্য থাকলে অগ্রযাত্রাকে কিছুতেই কেউ আটকিয়ে রাখতে পারে না। যেমন পারেনি ব্রাম্মণবাড়িয়া জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামকে। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মন থেকে শ্রদ্ধা সম্মান এবং গভীর ভালাবাসা এসে যায়। তাদেরকে দেখা মাত্র মনটা ভরে যায়। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কেবলি তার কথা শুনতে মন চায়। মনের গহীন অরণ্য হতে ভেসে আসে শুধু তাদের কথা। প্রশাসন মহলে তার সততা ও নিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।

তার আরেকটি পরিচয় আছে যা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলেও আরো বলতে ইচ্ছা হয়। তিনি হলেন একজন বিরহ কবি। যে কবি মানুষের মনের কথা, প্রাণের কথা, আত্মার কথা, হৃদয়ের কথা, জীবনের কথা মধুময় প্রেমের কথা তার কবিতায় তুলে ধরতে জানেন- তিনিই আসল কবি। যে কোন মানুষ তার কবিতাগুলো যদি পড়ে তার স্পন্দনে অবশ্যই দাগ কাটবে এবং তার কবিতাগুলি বারেবারে পড়তে ইচ্ছা করবে।

মানুষের জীবনের বাস্তব কথা নিয়ে এরকম জীবন্ত কবিতা কত জনে লিখতে পারে তা আমার জানা নেই, তবে বিরহ কবি শফিকুল ইসলাম যে তার কবিতা বইগুলির মাঝে মানুষের সর্বস্ব দিক নিয়ে যে কবিতাগুলি তিনি উপস্থাপন করেছেন এতে সত্যিই তিনি একজন বিরহের কবি। যে কবিকে লালন করা যায়, যে কবিকে সব সময় মনের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায়, যে কবিকে সবসময় অস্তিত্বের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়, যে কবিকে জীবনভর অনুভূতির মাঝে বাঁচিয়ে রাখা যায় আর সেই কবি হলেন শফিকুল ইসলাম।

তার কবিতাগুলি পড়লে শরীর ও মন চমক দিয়ে উঠে, কোন কোন কবিতায় চোখের জল ঝরায়। আবার কোন কোন কবিতায় অতীতকে স্মরণ করায়। আবার কোন কোন কবিতায় তিনি যে সত্যিকার অর্থেই একজন দেশপ্রেমিক তা সপষ্ট হয়ে উঠে। এই কবিতাগুলির বইয়ের মাঝে শফিকুল ইসলাম আজীবন বেঁচে থাকবেন ইতিহাস হয়ে। তার সমপর্কে লিখতে গিয়ে আরো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানসী কবিতা বইয়ের নিন্দুকের প্রতি নিবেদন কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ল-

হউক ধন্য তোমার যশ

লেখনী ধন্য হোক,

তোমার প্রতিভা উজ্জ্বল হয়ে

জাগাক সপ্তলোক।

মানুষ মাত্রেই মরণশীল। এই পৃথিবীতে অনেক লোক এসেছে, অনেক লোক চলে গেছে। মানুষ স্মৃতিময় হয় তার কর্মকান্ডে। জনাব শফিকুল ইসলামও রেখে যাচ্ছেন তার সুকর্মের স্বাক্ষর। মানুষ তাকে মনে রাখবে চিরদিন।

কবি, লেখক, সাহিত্যিক শফিকুল ইসলাম শত ব্যস্ততার মাঝেও গত ১জুলাই ২০০৯খ্রী জাতির আলো পত্রিকায়ে যে গুরত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার প্রদান করেন তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো। জাতির আলোঃ আপনি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের স্বনামধন্য আদালতসমূহে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একজন নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক শীর্ষে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কি?

শফিকুল ইসলামঃ বিচারকার্যে সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে বিচার প্রার্থীদের মধ্যে বিচারকের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। ফলে বিচারিক সিদ্ধান্ত তারা সহজেই গ্রহণ করে। বিচারকার্যে আন্তরিকতা, সততা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছি বলেই গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছি। মামলার পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমার অঙ্গীকারের সামান্য বাস্তবায়ন করে আমি বেশ আত্মতৃপ্তি পেয়েছি।

জাতির আলোঃ মুক্ত সাহিত্য চর্চার জন্য দেশে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা বিরাজ করছে কি?

শফিকুল ইসলামঃ মুক্ত সাহিত্য চর্চার জন্য মুক্তসমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজন। প্রথাগত সমাজে ধর্মীয় বাঁধা, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাধা মুক্ত সাহিত্য চর্চার অন্তরায়। জাতির আলোঃ একজন কবি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পাথর্ক্য কি?

শফিকুল ইসলামঃ সাধারণ মানুষ চোখ দিয়ে দেখে আর সেখানে একজন কবি দেখেন অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। জাতির আলোঃ দেশ ও দেশবাসীর কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?

শফিকুল ইসলামঃ মুক্তিবুদ্ধি চর্চার অনুকুল পরিবেশ। জাতির আলোঃ কবি, সাহিত্যিক, লেখক হবার জন্য মুল সহায়ক হিসেবে কি কি প্রয়োজন?

শফিকুল ইসলামঃ অন্তর্দৃষ্টি ও সৃষ্টির তাড়না। জাতির আলোঃ একজন মূলধারার লেখক হতে গেলে কি ধরনের বিশেষ গুণাবলী থাকা প্রয়োজন? শফিকুল ইসলামঃ ব্যাপক পঠন-পাঠন, বিরতিহীন অনুশীলন ও আন্তরিক প্রয়াস। জাতির আলোঃ কবিতার ভাষা ও মুখের ভাষা এক হওয়া কি প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

শফিকুল ইসলামঃ কবিতা হচ্ছে বিশেষ মুহুর্তের শ্রেষ্ঠতম আবেগময় প্রকাশ- কাজেই বিশেষ মুহূর্তে এক হতে পারে, সকল সময় নয়। জাতির আলোঃ চাকুরী জীবনের শেষে জনসেবা করার উদ্দেশ্যে জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন কি?

শফিকুল ইসলামঃ চাকুরী জীবনেও জনসেবার প্রচূর সুযোগ রয়েছে। জীবনব্যাপী মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থেকে এই জন্মের ঋণ শোধ করতে চাই; তা চাকরীজীবি/জনপ্রতিনিধি/রাষ্ট্রনায়ক যেকোন পদে থেকেই হোক। জাতির আলোঃ কোন উপদেশ আপনি মেনে চলেন ও অপরকেও উপদেশ দেন মেনে চলতে?

শফিকুল ইসলামঃ মানুষের প্রতি সদয় হও। জাতির আলোঃ লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

শফিকুল ইসলামঃ আরো বেশি বেশি লেখতে চাই, মানুষের না বলা কথা আরো বেশি বেশি বলতে চাই। জাতির আলোঃ আপনার লেখা কোন বইটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?

শফিকুল ইসলামঃ তবু ও বৃষ্টি আসুক। জাতির আলোঃ আপনি সবচেয়ে কোন বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন?

শফিকুল ইসলামঃ প্রেম ও দ্রোহ। জাতির আলোঃ কবিদের দেশের প্রতি কর্তব্য কি?

শফিকুল ইসলামঃ মানুষের মধ্যে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা জাগিয়ে রাখা। জাতির আলোঃ আপনি কি মনে করেন কবি সাহিত্যিকরা দেশ ও সমাজের পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে?

শফিকুল ইসলামঃ সাহিত্য যেহেতু সমাজ ও মানুষকে নিয়ে সেহেতু দেশ ও সমাজ পরিবর্তনে কবি-সাহিত্যিক অগ্রণী ভূমিকা পালনে সক্ষম। জাতির আলোঃ কোন জিনিস দেখলে আপনি বেশি খুশি হন এবং কোন জিনিস দেখলে আপনি দুঃখ পান?

শফিকুল ইসলামঃ পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয়- মানুষের হাসিমাখা মুখ যা আমাকে স্বর্গীয় আনন্দ দেয়- মানুষের ব্যথিত উদ্বিগ্ন মুখ আমাকে খুবই কষ্ট দেয়। জাতির আলোঃ একজন ভাল মানুষের কোন কোন গুণাবলী থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন?

শফিকুল ইসলামঃ একজন ভাল মানুষ তিনিই যিনি কথায় ও কাজে সৎ এবং মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালবাসাতে যার আনন্দ। জাতির আলোঃ সবার জীবনে রোমাঞ্চকর অধ্যায় আসে, আপনার জীবনে সেই রোমাঞ্চকর অধ্যায় কি এসেছিল?

শফিকুল ইসলামঃ একজন কবির জীবনের অনুভূতি/উপলব্ধি তার কাব্যে মিশে থাকে- কবির জীবনের রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের ঈঙ্গিত হয়ত কোন পঙক্তিমালায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

জাতির আলোঃ আপনার মত এরকম জীবন গঠন করতে গেলে জীবনকে কিভাবে সাজিয়ে নিতে হবে, আপনার জীবনের থেকে কিছু বলুন।

শফিকুল ইসলামঃ জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শে অবিচল থেকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যেতে হবে এবং কথায় ও কাজে সৎ হতে হবে। [জাতির আলো পত্রিকা ॥বর্ষ ৬॥সংখ্যা-৭॥ ১জুলাই ২০০৯ইং সংখ্যায় প্রকাশিত ব্রাম্মণবাড়িয়ার প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কবি শফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার]

কবিতার মাঝে জীবনবোধকে ফুটিয়ে তোলা কবি শফিকুল ইসলামের নিরন্তর সাধনা

তাসলিমা খানম বীথি(সিলেট এক্সপ্রেস): কবিতার মাঝে জীবনবোধকে গভীরভাবে অন্বেষণ করা কবি শফিকুল ইসলামের নিরন্তর সাধনা। জীবনের আশা-নিরাশা,হতাশা-বঞ্চনা কবিকে আন্দোলিত করলেও কবি তার কাব্য ভাবনায় কখনও বিচলিত হননি......তা তার কাব্যে সুষ্পষ্ট।প্রকৃতি ও প্রেম তার কাব্যে অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। তরুণ হৃদয়ের অব্যক্ত আবেগ কবি তার কবিতায় বাণীবদ্ধ করেছেন যা সার্বজনীন আবেগের বহিঃপ্রকাশরূপে মূর্ত হয়েছে। স্মৃতিময় অতীত, প্রেম ও বিরহ বিচ্ছেদ চেতনাসমৃদ্ধ তিনি কবিতা ধারন করে রেখেছেন তার কাব্যগ্রন্থ। সিলেটের প্রথম অনলাইন দৈনিক সিলেট এক্সপ্রেস ডট কম-এর পক্ষ থেকে কবি শফিকুল ইসলাম’র একটি সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়।২৪ আগষ্ট ২০১৪ সালে সুরমা নদীর পারে, ক্বীনব্রীজের পাশে অবস্থিত সিলেট সার্কিট হাউজে বসে তিনি সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেন । সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সিলেট এক্সপ্রেস-এর স্টাফ রিপোর্টার তাসলিমা খানম বীথি এবং সাথে ছিলেন সিলেট এক্সপ্রেসের স্টাফ রিপোর্টার ও আলোকচিত্রী মাহমুদ পারভেজ।

বীথি: কবিতা বলতে আপনি কী বুঝেন ?

শফিকুল ইসলাম: আমার নিজের একটি সংজ্ঞা আছে। যেমন কবিতা হচ্ছে মনের অভিব্যক্তি। যা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে অন্যের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

বীথি: আপনার কবিতায় মাধ্যমে পাঠকের উদ্দেশ্যে আপনি আসলে কি বলতে চেয়েছেন মানে আপনার কাব্যের মূল মেসেজ কী?

শফিকুল ইসলাম: আমার কাব্যগ্রন্থ ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’-এর প্রথম কবিতায় আমি আমার কাব্য ভাবনার মূল মেসেজ তুলে ধরেছি। কবিতার মাধ্যমে মানুষে মানুষে স¤প্রীতি, সহমর্মিতা, বিবেক বোধকে আমি উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি। কিছু পংক্তিমালায় আমার কাব্য চেতনার মূল মেসেজ খুঁজে পাওয়া যাবে, যেমন-

‘তার ও আগে বৃষ্টি নামুক

আমাদের বিবেকের মরুভূমিতে

সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক

আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা, হৃদয়ের গ্লানি।"

(কবিতা:তবুও বৃষ্টি আসুক)

বীথি: সম্প্রতি কবিতা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না, এর মূল কারণ কী?

শফিকুল ইসলাম: যারা কবিতা লেখছে তারা মনে করে বাক-চাতুর্য। কেউ মনে করে কবিতা অন্ত্যমিল মিলে গেলেই সেটা কবিতা। সেটা কিন্তু কবিতা না। যেমন- গাছের সাথে মাছ মিললেও কবিতা হবে না। কবিতা এমন একটি বিষয় যা তার ভাব বা বক্তব্যকে ছাড়িয়ে যখন আরো কিছু প্রকাশের ইঙ্গিত দেয় তখনই সেটা কবিতা হয়ে ওঠে। উদীয়মান কবিদের কবিতায় অন্তর্নিহিত যে ছন্দ বা সুর আছে কবিতা লেখতে এ বিষয়টা উপলব্ধি করতে হবে। বীথি: কবিতাকে পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার জন্য কবিতা কেমন হওয়া উচিত? শফিকুল ইসলাম: সাহিত্যে শুধু লেখার জন্য না, মানুষের জীবনের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন থাকতে হবে। যেহেতু লেখক তো শুধু নিজের জন্য লেখেন না, পাঠকের জন্য লেখেন। সেজন্যে কবিতার পাঠক তার জীবনের সুখ-দু:খের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেলে কবিতাটি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবে। বীথি: কিসের তাড়না আপনাকে কবিতা লেখতে বাধ্য করে?

শফিকুল ইসলাম: মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ আসে লেখার জন্য। বাস্তবজীবনে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত যখন হৃদয়ে নাড়া দেয় তখনি সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা পাই, প্রেরণা জাগায় । বীথি: আপনার কবিতার মধ্যে প্রেম কতটুকু আছে?

শফিকুল ইসলাম: প্রেম হচ্ছে হৃদয়ের একটা প্রবল অনুভূতি। যা জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। স্বাভাবিকভাবে আমার কবিতায় প্রেমের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। যা আমার কাব্যগ্রন্থের অনেকাংশই জুড়ে আছে।

বীথি: সাহিত্য চর্চায় আপনার মূল লক্ষ্য কী?

শফিকুল ইসলাম: শুধুমাত্র সাহিত্যের জন্য সাহিত্য চর্চা আমার মূল লক্ষ্য নয়। মাটি ও মানুষকে আমি ভালোবাসি। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছাকাছি পৌছার লক্ষ্যে সাহিত্যকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছি। তাই আমার কাব্য শুধু প্রেম নয়, আছে মানুষের দূর্বার সংগ্রাম আন্দোলনের কথা। বীথি: বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা সর্ম্পকে আপনার মূল্যায়ন কী?

শফিকুল ইসলাম: আমি মনে করি সামাজিক বৈষম্য সমাজ জীবনে অস্থিরতার মূল কারণ। যদিও অন্যান্য আরো কারণ থাকতে পারে। সমাজে সম্পদের সুসম বন্টণ সমাজ জীবনে উন্নতি আনতে পারে। বীথি: জীবনের শেষ হচ্ছে কী?

শফিকুল ইসলাম: আমার জীবনে শেষ ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি.....

‘সংসার মাঝে দু’একটি সুর

রেখে দিয়ে যাবো করিয়া মধুর

দু’একটি কাটা করি দিব দূর

তারপর ছুটি নিব। বীথি: নতুন লেখকের জন্য আপনার পরামর্শ কী? শফিকুল ইসলাম: লেখক হবার আগে প্রচুর পড়তে হবে। ভালো লেখকদের বই বেশি করে পড়তে হবে।

বীথি: বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান? শফিকুল ইসলাম: শান্তি সমৃদ্ধি ও শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে দেখতে চাই। যেখানে বাংলাদেশের জনতা অর্থনীতিক মুক্তি পাবে। বীথি: দেশ ও জাতিকে নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী? শফিকুল ইসলাম: দেশ ও জাতিকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কর্মজীবন শেষে আমি সিলেটবাসি তথা দেশের জনগণের সেবায় আরো জোরালোভাবে আত্মনিয়োগ করতে চাই।

কবিকে যেমন দেখেছি

কবি শফিকুল ইসলাম, তাকে যেমন দেখেছি

--এম এ মান্নান রিপন

সাহিত্যিক ও শিক্ষক ।

নিভৃতচারী কবি শফিকুল ইসলাম আধুনিক কবিতায় নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন।বাংলা সাহিত্যের সম-সাময়িক এ যুগে যখন কাব্যচর্চায় পাঠকদের মধ্যে অনেকটা অনিহা দেখা দেয়।তখন তার কবিতা পাঠকদের মধ্যে একটা উদ্দিপনা তৈরি করে।আশির দশকে যখন গণতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্থ হয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হয়, সাহিত্যচর্চার প্লাটফর্মগুলো সংকুচিত হয়ে আসে। তখন বাংলা সাহিত্যঙ্গণে আর্বিভাব হয় এই নিভৃতচারী কবির। অনেকটা নিরবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সমসাময়িক যুগের অবক্ষয়কে। সামাজিক শোষণ, অত্যাচার, অবিচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে কলম ধরেন তিনি তার Ôদহন কালের কাব্য’ ও Ôপ্রত্যয়ী যাত্রা’ কাব্যগ্রন্থে।মানবতাবাদি এই কবির মানবতার বাণী ‘তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে।বইটির প্রথম কবিতায় মানবতাহীন এই হিংস্র পৃথিবীতে কবির চাওয়া বিশ্ব মানবের সার্বজনীন আকাংখা হয়ে ধরা দিয়েছে। কবি বলেছেন–

‘তারও আগে বৃষ্টি নামুকআমাদের বিবেকের মরুভূমিতে-সেখানে মানবতা ফুল হয়ে ফুটুক,আর পরিশুদ্ধ হোক ধরা,হৃদয়ের গ্লানি…

(কবিতা:তবুও বৃষ্টি আসুক’)

কবি শফিকুল ইসলামের সাথে পরিচয় ২০০৮ সালের প্রথম দিকে। তখন আমি সাপ্তাহিক তিতাস পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করি। এখানকার পত্রিকায় লেখার খোরাক রাজনীতি নামক ফলের টনিক। তাই কী অথনীতি, কী সংস্কৃতি বা কী সাহিত্য, এগুলোর কোন বালাই ছিলনা।তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামক সংস্কুতির রাজধানীতে শিল্প সাহিত্যচর্চা অনেকটা চার দেয়ালের ভিতরেই ছিল। সে সময়ে কবি শফিকুল ইসলামের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগমন অতি:রিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই সম্পাদক রেজাউল করিম একদিন কাজের ফাকেঁ শফিকুল ইসলামের গল্প শোনালেন। শুনে অনেকটা কৌতুল নিয়ে তার অফিসে একদিন যাওয়া।

একজন মানুষকে একদিনের আলাপচারিতায় হয়ত চেনা অসম্ভব, তবে একজন কবিকে চিনতে আমার বেশি সময় নেয়নি।কবি যদি হয় সেই ব্যক্তি যিনি মানুষের মনে কোন অনুভূতি সৃষ্টিকারী তবে কবি শফিকুল ইসলাম তাই।তার দৃষ্টিভঙ্গি, চেতনা, আদর্শ, স্বপ্ন, কল্পনা, ভাবনা সব কিছুতেই ছিলনা সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা, দ্যোতনা, কাব্যময়তা।অনেকটা আশ্চর্য হয়ে তাকে শুনে যাচ্ছিলাম।মনে হচ্ছিল সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত মানবতার দেবতার কাজ থেকে মানবতার বাণী শুনছি।সেদিন হৃদয়ে দাগ কেটেছিল এ শুনে যে মানবতাও ফুল ফুঁটাতে পারে!

আস্তে আস্তে কবির সান্নিধ্যে আমরা যারা ছিলাম, যারা সেদিন তাকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে দেখছিলাম, একজন প্রশাসক হিসেবে নয়। তারা অনেকটা বিমোহিত হয়েছিলাম মানবরূপী দেবতার সন্ধান পেয়ে।

কবিদের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব থাকেনা।সফলতা-ব্যর্থতা বলতে যা বুঝায় তা অনেকটাই গৌণ।তাই কবি শফিকুলকে মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে অনেকটা দুরূহ। তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ আমি পড়েছি। অনেকগুলোর পর্যালোচনাও করেছি। সব মিলিয়ে লিখতে গেলে আজকের লেখার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। তাই কবি সম্পর্কে যা না বললেই নয় তা হল, কবি শফিকুল ইসলাম একজন বহুমাত্রিক লেখক।তার কবিতায় দ্রোহ-প্রেম যেমন স্থান পেয়েছে, সমান তালে ঠিক তেমনি মানবতা, মানবিকতার বিপর্যয়ও স্থান পেয়েছে।

সুলতা নামক কাব্যিক চরিত্রটি কবির অনন্য সৃষ্টি। সুলতা একটি রহস্যময় চরিত্র। কবি জীবনানন্দ দাসের বনলতা সেন যেমন পাঠক মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, কবি শফিকুল ইসলামের সুলতাও পাঠক মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ বিষয়ে হয়তবা কারও বলার থাকতে পারে যে কবি ইচ্ছা করেই এমন একটা চরিত্র দাড়ঁ করিয়েছেন।কিন্তু আমি বলব যে না,কবি মনের সৃষ্টি হল সুলতা।সুলতা চরিত্রকে কবি তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে তৈরি করেছেন। সুলতা কবির অস্তিত্ব নয় কিন্তু জীবনের অনুপ্রেরণা।জীবন চলার পথে প্রেরণা। সম্ভবত এই নারীই কবির মধ্যে কবিত্ববোধ এনে দিয়েছেন। কবি জীবনের সুধা পান করেছেন এই নারীর প্রেম থেকে।তবে তিনি প্রাপ্তিতে রূপ দেননি, দিয়েছেন ত্যাগে। এখানেই কবি জীবনের পূর্ণতা।সম্রাট শাহজাহানের সৃষ্টিতে যদি মমতাজ চির স্মরণীয় হয় কবির কাব্যকর্মে সুলতার মাধ্যমে কবি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

দুঃখবাদি কবির দুঃখের যন্ত্রণা তার কাব্যে প্রতিয়মান। প্রচলিত জীবনযাত্রায় তাকে দেখলে হয়তা তা উপলব্ধি করা যাবেনা কিন্তু তার কাব্যে দুঃখের ছাপ প্রতিফলিত হয়েছে। তবে কবির দুঃখ কোন ব্যর্থতা, না পাওয়ার বেদনা, বা নজরুলের দারিদ্রতা নয়। কবির দুঃখের কারণ মানবতার বিপর্যয়, সভ্যতার সংকট, মানুষে মানুষে ঘৃণা।

কবি শফিকুল ইসলামের ব্যক্তিক জীবনবোধ ও সমাজচিন্তা তাকে সাহিত্যঙ্গনে অমর করে রাখবে।তার কাব্যগ্রন্থ্যগুলোতে বাংলাদেশের সমাজ চিন্তার বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে।বিশেষ করে মানবতার অবক্ষয়, সময়ের বৈরীতা প্রকাশ পেয়েছে।তার কবিতায় সমাজ ও দর্শন অত্যন্ত সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

প্রচারবিমুখ কবি শফিকুল ইসলামের প্রশাসনে চাকুরীর বিধিবদ্ধ সীমাবদ্ধতার কারণে তার অনেকটাই আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।তবে সেই দিন বেশি দূরে নয় । যুগের অমূল্য এই কবি অচিরে বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় বায়রণ হবে। কবির দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

কবি শফিকুল ইসলা : জীবন কর্ম

--মোহাম্মদ ইদ্রিস

মস্তিষ্ক, বিবেক আর ইন্দ্রিয় খোলা রেখে যে মানুষ যাপিত জীবনের প্রতিটি শাখা প্রশাখা পার করেন তাকেই আমরা পূর্ণাঙ্গ বলতে পারি। আমার দেখা কবি শফিকুল ইসলাম তেমনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যে মানুষ বড় হয় কর্মের মাধ্যমে। যে মানুষের কর্ম পরিধির সুরভী ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে।

তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় হয় ২০০৮ এর দিকে। তিনি তখন আমার প্রিয় শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সাহিত্যরসে পূর্ণ এই মানুষটি আপদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি দেশপ্রেমিক। মানুষের কল্যাণই তাঁর আজন্ম সাধনা। এইরকম সৎ, কর্মের প্রতি নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, নির্লোভ, বিনয়ী, নিরহংকারী মানুষ আমার জীবনে হয়তো ২/১ জনকেই দেখেছি। আমি তাঁর কর্মীসত্তার দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমত: সাহিত্যিক শফিকুল ইসলাম। দ্বিতীয়ত: কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে শফিকুল ইসলাম।

সাহিত্যিক শফিকুল ইসলাম

একজন নির্ভীক, সত্যাচারী, বিশ্বময় কল্যাণকামী কবি ও লেখক শফিকুল ইসলাম। শফিকুল ইসলাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ঢাকায় দীর্ঘ সময় চাকুরি করেছেন। এরপর তিনি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন তিতাস নদীর পলিতে উর্বর এক ভুমিতে, যেখানে গান আর কবিতা এক সাথে খেলা করে সেই সুর ও সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেই তিনি অল্প দিনের মধ্যে একজন সৎ ও জনবান্ধব অফিসার হিসেবে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হোন। এ সময় তাঁর লেখা বহুল আলোচিত ও পঠিত তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। একই সময় প্রকাশিত হয় মেঘ ভাঙা রোদ্দুর, শ্রাবণ দিনের কাব্য । এরপর একে একে প্রকাশিত হয়- দহনকালের কাব্য, প্রত্যয়ী যাত্রা প্রভৃতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার আগে প্রকাশিত হয়- একটি আকাশ ও অনেক বৃষ্টি, এই ঘর এই লোকালয়। তিনি বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশন এর তালিকাভূক্ত গীতিকার।

তবুও বৃষ্টি আসুক’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি নজরুল স্বর্ণপদক লাভ করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কবি শফিকুল ইসলাম এই দুটি সত্তা ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন সময়ের অত্যন্ত শক্তিশালী কবি শফিকুল ইসলাম হিসেবে। এসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৌর এলাকায় সাপ্তাহিক অগ্রধাপ পত্রিকা তাঁকে প্রথম কবি হিসেবে সম্মাননা ও সংবর্ধনা দেয়। এরপর সরাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং কসবায় একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে এবং আখাউড়া লেখক ফোরাম তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থেকে লেখক শফিকুল ইসলাম হয়ে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হোন।

তাঁর কবিতায় আছে প্রেম, আছে দ্রোহ, আছে শান্তির অণ্বেষণ, আছে না পাওয়ার বেদনা। নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁর কবিতা কখনো হয়ে ওঠে বিশ্বময় চেতনাধারী। আবার কখনো বা সুলতাকে না পাওয়ার বেদনাময় রাতের মেদকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। কখনো বা তিনি প্রকৃতির খুব কাছে গিয়ে প্রিয় কিছুকে খুজেছেন। এই সত্তা হতে পারে তাঁর পার্থিব জীবনের চাওয়া পাওয়া এবং না পাওয়ার বেদনায় ককিয়ে ওঠা বাঁশির করুণ সুর। আবার কখনো প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার মাঝে নিজের দেশকে খোজে নেবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় দেখি কবি শফিকুল ইসলাম শুধুই একজন প্রেমিক কিংবা মানবতাবাদী কবিই নন তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। প্রকৃতিপ্রেমিক।

সুলতা তাঁর কবিতার আলো। অথবা কবিতায় আলো ছড়ানো এক দ্যুতিময় গীতাঞ্জলী। যে সুলতার জন্য কবির আহার নিদ্রা সব একাকার। বাস্তবে কে এই মোহময়ী মায়াবিনীর ছায়া সুলতা, তাঁর সম্পর্কে কবির নিকট থেকে কিছুই জানতে পারিনি। সে এক অপার বিস্ময় অথবা রহস্যের আঁধার মাত্র। এছাড়া আমি অন্তত সুলতা সম্পর্কে আর কিছু পাঠোদ্ধার করতে পারিনি। তবে এইটুকু মনে করতে পারি যে সুলতা কবির জীবনের এ্‌ক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যার নিকট থেকে কবিকে আলাদা করা যায় না। আর আমি এটাও বুঝি যে, সুলতার মাঝেই লুকিয়ে আছে কবি শফিকুল ইসলামের সকল কাব্য ভাবনা।

কাব্যচর্চার জন্য তিনি বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ পুরষ্কার থেকে স্বর্ণপদকসহ একাধিক পদকে ভূষিত হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর লেখা ছড়িয়ে আছে। আমাদের এই চিরচেনা কবি শফিকুল ইসলামের কবিতা আজ হাঁটছে বিশ্বময়। মানবতার জয়গান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কবিতা সেই এশিয়া থেকে আফ্রিকা, সেখান থেকে ইউরোপ আমেরিকার সর্বত্র অন্তর্জালের মাধ্যমে। সত্যি বলতে কি তাঁর কাব্য প্রতিভা অনন্যসাধারণ। আমার দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবিদের মাঝে তাঁর অবস্থান প্রথম সারিতেই।

কর্ম ব্যক্তিজীবনে শফিকুল ইসলাম

আমার সাথে তার পরিচয় মুলত লেখালেখিকে কেন্দ্র করেই। অফিস সময়ের পর আমরা প্রায়শই সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতাম। তিনি অফিসে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলেও তিনি অফিসের বাজেট থেকে কোন কিছু খেতেন না। যা খেতেন বা আমাদেরকে খাওয়াতেন তা তার নিজের অর্থে। তাঁর মতো এই রকম সৎ অফিসার আমার জানামতে সত্যিই বিরল। আমার মনে আছে একদিন তার অফিসের পিএ ও অন্যান্য স্টাফদের ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, আমি এখানে এসেছি মানুষকে সেবা দিতে। কাজেই কেউ যেন আমার সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। তিনি আরো বলেছিলেন, যদি উপরি টাকার দরকার হয় তবে তা আমার নিকট থেকে চেয়ে নেবেন। কোন সেবাপ্রত্যাশী যেন হয়রানীর শিকার না হয়।

একদিনের ঘটনা বলছি- একজন সরকারি উকিল কিছু ফাইল নিয়ে স্যারের দপ্তরে আসেন। স্যার তাকে বসতে দেননি।প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন কেনো এসেছেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন কিছু অনৈতিক আবদারের কথা। স্যার তাকে বলেছিলেন, মাথার চুল পেকেছে। দাড়ি পেকেছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সবই সাদা (পবিত্র)- এবার ভাল হয়ে যান। আমি আপনার অন্যায় আবদার মেনে নিতে পারবো না।

তাঁর টেবিলে কখনোই কোন ফাইল পড়ে আছে, জমে আছে এমন নজির আমি দেখিনি। যেকোনো ফাইল আসা মাত্র তিনি তা দেখতেন এবং তার কাজ করে দ্রুত টেবিল বদল করে দিতেন। তাঁর মতো এমন একজন সৎ নিষ্ঠাবান অফিসার আজকের সমাজে সত্যিই বিরল। একবার সরকারি খরচে খাবারের আয়োজন করা হলে তিনি সেই খাবার গ্রহন করেন নি। আমাকে বললেন, ১৬ কোটি মানুষের টাকায় কেনা খাবার আমি কীভাবে খাবো? সরকার আমাকে বেতন দেয় কি জন্যে? আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম।

তিনি সকালে অফিসে এলে ফিরতেন রাতে। দুপুরের খাবার অফিসেই সেরে নিতেন। তিনি এমন এক কর্মপাগল মানুষ যে আমি তাঁকে বলি কর্মবীর। কাজকেই তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। কখনো তাঁকে রাগতে দেখিনি। রাগ করার মতো পরিস্থিতি তাঁর সামনে দেখেছি। তিনি রাগ করেননি। বিনয়ের সর্বোচ্চ শিখরেই তাঁর অবস্থান।

আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইস্টার্ন মিডিয়ার বার্তা সম্পাদক। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি মেয়েকে বাঁচানোর জন্য সাহয্যের হাত প্রসারিত করে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। ওই কনসার্টে নায়ক ফেরদৌস, গায়িকা সালমা সহ আরো খ্যাতিমান তারকাশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যা ৬ টায় কনসার্ট শুরু হবে। টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসনের অনুমতি পাওয়া সম্ভব হয়নি। পত্রিকার সম্পাদক আমাকে ডেকে বললেন আপনার সাথে শফিকুল ইসলাম স্যারের পরিচয় আছে । একটু চেষ্টা করেন। আমি স্যারের সরকারি বাসভবনে চলে গেলাম। শফিকুল ইসলাম স্যার এক ঘন্টার মধ্যে সরকারি অনুমতির ব্যবস্থা করে দিলেন আমার হাতে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম ডায়নামিক অফিসার না হলে এই রকম করিৎকর্মা হওয়া সম্ভব নয়।

আরেকটি ঘটনা বলতেই হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইস্টার্ন মিডিয়া পত্রিকাটিকে মিডিয়া তালিকাভুক্ত করার করার জন্য আমি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলাম স্যারের সহযোগীতা চাইলাম। স্যার আমাকে বললেন, বসুন আমি দেখি কীভাবে কি করা যায়। তারপর তিনি নিজেই কম্পিউটারে একটি চিঠি টাইপ করলেন। এরপর দুই কপি প্রিন্ট করে জেএম শাখায় পাঠালেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তা ওকে করে আনলেন। এ সময় স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম কাজ করার এক স্বর্গীয় আনন্দ তাঁর চোখে মুখে খেলা করছে।

আমার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বললেন, আরো একটু কাজ বাকি- আপনি বসুন। তারপর তিনি ফোন করলেন পাশের ভবনে এসপি সাহেবের কাছে । আমার নাম এবং চেহারার বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন, আমি ছেলেটিকে পাঠাচ্ছি, কাজটি যেন দ্রুত করে দেয়া হয়।

আমি স্যারের কথায় এসপি সাহেবের অফিসের কাছে যেতেই একজন কন্সষ্টেবল আমাকে ডেকে বললেন, আপনার নাম কি অমুক? আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। তিনি আমাকে পুলিশ সুপারের রুমে নিয়ে গেলেন। এসপিকে আমি সালাম দিতেই আমাকে বসতে বললেন। আমি এক কাপ রং চা পান শেষ করার আগেই আমার হাতে কাগজ এসে হাজির । আমি যারপরনাই অবাক হলাম। এই হলো আমাদের শফিক স্যার। যিনি মাসের কাজ ঘন্টার আগে করেন। সত্যিই সেদিনের কথা আমি আমার এক জনমে ভুলতে পারবো না। একেই বলে সত্যিকারের জনবান্ধব অফিসার। মনে মনে স্যারকে সেদিন স্যালুট জানালাম।

(সংক্ষেপিত)

বাংলা সাহিত্যের উজ্জল ধ্রুবতারা কবি ও গীতিকার শফিকুল ইসলাম

--কবি মুহাম্মদ শামসুল হক শামস্‌

গীতিকার (বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন)

এই দেশের কৃতি-সন্তান আলোচ্য কবি ও গীতিকার জনাব শফিকুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে উঠা সিলেট জেলার পাললিক প্রাণ-কেন্দ্র শহরের শেখঘাটস্থ খুলিয়াপাড়ায় ১৯৬৩ সালের ১০-ই ফেব্রুয়ারী । জন্মগত কবি প্রতিভার অধিকারী কবি শফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও সমাজ কল্যাণে মাষ্টার্স এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে এম,এ ইন ইসলামিক স্টাডিজ ডিগ্রী অর্জন করে ।

বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রনালয়ের উপসচিব । কর্ম জীবনে এ এক বিশাল অর্জন তাঁর। তারপরও থেমে নেই তাঁর ক্ষুরধার লেখনী প্রতিভা । চাকরীর অবসরে নীরবে-নিভৃতে শুধু তাঁর একই কাজ কিছু লেখা আর ভাবা । ইতোমধ্যে তাঁর অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য-কর্মের জন্যে পেয়েছেন স্বর্ণ পদকসহ বেশ কিছু বিরল সম্মাননা ।

ইংরেজী ২০০৮ সালের কথা । চাকরীর সুবাদে আমি তখন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা । লেখালেখির অভ্যাস, তাই শহরের শিল্পকলা একাডেমিতে সচরাচর বিচরণ । একদিন সন্ধ্যা বেলায় শিল্পকলা একাডেমিতে ঢুকেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক জনাব আলী মোসাদ্দেক মাসুদ গান তৈরী করা নিয়ে ব্যস্ত। তার পাশে বসা আরেক জন। আমার মনে প্রশ্ন জাগে কে ইনি?

তাদের পাশাপাশি বসার কিছুক্ষণ পর আমাকে পরিচয় করানো হয়, ইনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম), ভালো গান লিখেন। বসার ধরণ দেখেই আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের তানপুরা নিয়ে যোগাসনে বসার ভঙ্গিমায় আরেকজন সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষ যেন বসে আছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ভেতরে।

পরিচয়ের পর থেকে কবির সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা খুবই নিবিড় হয়ে যায় । তখন আমি বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের উত্তরণ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে বই পরিচিতি পর্বে লেখালেখি করি । কবি শফিকুল ইসলাম জানতে পেরে তাঁর কাব্যগ্রন্থ Ôতবুও বৃষ্টি আসুকÕ গ্রন্থটি পর্যালোচনার জন্যে আমাকে দিলেন। এটি বেতারে প্রচারিত হলে পর আরো তিনটি গ্রন্থ যথাক্রমে Ôশ্রাবণ দিনের কাব্যÕ, Ôএই ঘর এই লোকালয়Õ ও Ôপ্রত্যয়ী যাত্রাÕ পর্যালোচনা করি এবং ঢাকা বেতারের উত্তরণে প্রচারিত হয় ।

কবি শফিকুল ইসলামের কাব্য প্রতিভার প্রধান দিক তাঁর গ্রন্থের কবিতাগুলো কাব্যরসে পূর্ণ, কবিতার ছন্দ ও গাঁথুনি প্রাঞ্জল। রোমান্টিক ও প্রতিবাদী কবিতাগুলো আরো দারুণ, চেতনায় প্রচণ্ড নাড়া দেয়ার মত আরো সুন্দর । তাঁর গদ্য কবিতায় বাক্য গঠনের যে অবারিত প্রবাহ, উপমার সংমিশ্রণ, হৃদয় ছোঁয়া অনুভুতির প্রকাশ সত্যিই অপুর্ব! কবির কবিতার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিটি কবিতা এক দমে পড়া যায়, কোথাও থামেনা বা বাধাগ্রস্থ হয়না । কোথাও ছন্দ পতন নেই, বিন্যাসের আড়ষ্টতা নেই অর্থাৎ তাঁর কবিতায় অনুপ্রাসের মেদ নেই তবে শব্দের ভেতর ছন্দের তরঙ্গ আছে । আধুনিক কবিতা নিয়ে অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন কিন্তু লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না । কবি ও গীতিকার শফিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে তার অতুলনীয় দক্ষতা প্রমাণ করেছেন ।

এ তো গেল কবিতার কথা। গানের ব্যাপারে যারা গান লিখেন সবাই জানেন গান একটি কঠিন সাবজেক্ট । গান লেখা শুরু হয় অন্তরের আবেগ দিয়ে, গান লেখা শেষ হয় সঙ্গীতের কঠিন ব্যাকরণ ছন্দ-তাল-লয় দিয়ে । গীতিকার জনাব শফিকুল ইসলাম এখানেও তাঁর মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গান রচনা করে যাচ্ছেন ।

তাঁর দেশাত্ববোধক গানগুলো খুবই সুন্দর । আধুনিক পল্লী-গীতিসহ গানের অন্যান্য সকল ধারায় তাঁর অবাধ বিচরণ সমান-সমান । তাই তো তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন স্বনামধন্য তালিকাভুক্ত গীতিকার । যিনি সাহিত্য-কর্মের মাধ্যমে মানুষের জন্যে প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু সৃষ্টি করে যাচ্ছেন । আমি তাঁর লেখক সত্তার দিগন্ত-বিস্তৃত সমৃদ্ধি ও আকাশ-ছোয়া উন্নতি কামনা করছি।

কবি রচিত বইসমূহের তালিকা

কবি শফিকুল ইসলামের কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত সনদ ও মানপত্র

বিভিন্ন সংগঠন থেকে প্রাপ্ত পুরষ্কারের ছবি