Oder Katha in Bengali Short Stories by Samir Sinha books and stories PDF | Oder Katha (ওদের কথা)

Featured Books
Categories
Share

Oder Katha (ওদের কথা)

'ওদের কথা '

সমীর সিন্ হা

'মাসের' প্রায় শেষের দিকে পৌঁছে গেছি... টার্গেট উত্তেজনায় 'বসের' সঙ্গে কথোপকথন মোবাইল এখন মুখরিত ।

দিনের শেষে, 'চা'- সিগারেট আর মোবাইল ফোন নিয়ে বেশ কিছুক্ষন ব্যাস্ত হয়ে পড়ি আর এতটাই যে আশেপাশে, কোন ঘটনাই আর নজরে পড়ে না...

হঠাৎ তখনই মনে হয় কেউ যেন জামা ধরে টানলো। পিছনমুড়ে আচমকা দেখলাম, এক ৭-৮ বছরের ছোট একটা মেয়ে।

- বাবু , হাত বাড়িয়ে - ভিক্ষা দাও না।

- আমি, পিছনের পকটে হাত ঢুকিয়ে যা পেলাম তাই দিলাম কি করবি জিজ্ঞেস করলাম?

- 'ভাত' খাবো।

- ৫ টাকায় ভাত হয় ??

- অল্প করে খাবো।

- কত টাকা হলে বেশি করে খাবি ?

- ঐ শুধু ভাত ৪০ টাকা আর তরকারি নাহলেও খালি ডাল হলেই চলবে, ১০ টাকা। সবমিলিয়ে ঔ ৫০টাকা । দেবে তুমি ?

- 'হুম' দিতে পারবো !

- এত টাকা দেবে !! (চোখে মুখে বিস্ময়) তাহলে ভাত - তরকারি কিনে দিতে হবে না,একটা অন্য জিনিস দেবে ?

- কি সেই অন্য জিনিস ?

- ঐ টাকার চাল কিনে দাও। ঘরে নিয়ে যাবো। মা' এর সাথে খাবো।

আজ তো অনেক খানি বেলা হয়ে গেল আবার জোর বৃষ্টি এসে গেল কেউ 'ভিক্ষা' দেয় নি তুমি ছাড়া ।

- তোর নাম কি?

- 'লক্ষী'

- সত্যি মনে হল, 'লক্ষীর' ঘরে এমন অর্থাভাব আগে কখনো দেখিনি ।

- বাড়িতে কে কে আছে তোর ?

- মা, বোন আর দাদা । মার অসুখ তাই কাজ করতে পারেনা। বোন বাড়ি বাড়ি 'ঝি' - এর কাজ করে। দাদা চা এর দোকানে থাকে আর আমি 'ভিক্ষা' করি।

- তোর বাবা ?

- উপরে চলে গেছে অনেক আগেই , দেখিনি কখনও ।

(2)

-'হুম', পড়াশোনা করিস নাকি জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবছি তার আগেই 'লক্ষীর' জবাব এল

- পড়লে ভিক্ষা করতাম কখন ? খাওয়া জুটবে না।

সামনের দোকান থেকে ১ কেজি চাল আর কিছু ডিম, ডাল কিনে দিয়ে বিদায় নিলাম। ৪ জনের সংসারে একদিন চলে যাবে।

খুব অদ্ভুত, বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠে ওরা।খুব অল্প বয়সেই জীবনকে বুঝে নিতে শেখে।

৭ বছরে যথাসম্ভব আমি “কেজি-ওয়ান কিংবা কেজি - টু” এ পড়তাম। বিকালে ছবি আঁকতাম আর বই পড়তাম, অবসরে ওটাই শখ ছিল। নিশ্চিন্তে ছবি আঁকতাম। খাবার জুটবে কোথা থেকে এই চিন্তা অন্তঃত ছিলনা।

“পড়লে খাওয়া জুটবে কোথা থেকে” এই ধরণের প্রশ্ন কোন দিন মাথায় আসেনি । এগুলো ভাবার জন্য বাবা-মা ছিল।

রোজ স্কুলের হাত খরচা ছিল পাঁচ টাকার বেশকিছু টাকা টিফিন খরচ হিসাবে বাবা দিতেন । টিফিনের সময় চলতো ঝালমুড়ি, কাটা সসা বিট লবন দিয়ে, তেঁতুল আচার সেলোফেন পেপারে মোড়া আর আম আইসক্রিম এসব কিছু খেয়ে পয়সা বাঁচিয়ে ছোটবেলায় কলম কিনেছি আমার শিক্ষার উপকরণ হিসেবে আর 'লক্ষী' ৫ টাকায় ভাত খোঁজে তার বেঁচে থাকার উপকরণ হিসেবে । এতটুকুই যা পার্থক্য,

রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে 'লক্ষীরা' ভাবে রোজ সকালে “কোন রাস্তায় ভিক্ষা করলে বেশি টাকা পাবে” আর সময় নষ্ট না করে কত অচেনা লোক এর কাছে পৌঁছে যেতে পারে ভিক্ষার আসায়। ওদের কাছে প্রতিটি রেড লাইট, অচেনা বাস স্ট্যান্ড আর অচেনা মানুষজন জীবনের বেঁচে থাকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ।

আমাদের জীবন যাত্রা উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে শহরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফ্লাইওভার গুলো বড় হচ্ছে, 'প্রদীপ এর নীচে যেমন অন্ধকার থাকে' তেমনি ফ্লাইওভার এর নীচে জমে থাকা অন্ধকারে সম্মুখীন দিন- দিন, প্রতি- দিনই 'ওলা' চড়ে বাড়ি যাওয়ার পথে.....

রাস্তাই ওদের জীবন- মরনের ভরসা, ঝড় বৃষ্টি ভেজা শহরে একমাত্র মাথা গোঁজার জায়গা, একদিন থমকে গিয়ে দেখি রাতের খাবার প্রস্তূতি তখন জোরকদমে - খালি হাতে তন্দুরি রুটি গরম কাঁচা লোহা তাবায় সেঁকে, চুলা তৈরী করা হয়েছে খালি চারপাশে ইটের টুকরো ঘিরে ।আর এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে কিছু বাসনপত্র ।

- লোহা কাটার 'টেনসর্' এখানে সবজী কাটার ছুরি হয়ে কাজ করছে।

- সব্জি রান্নার বিধিবদ্ধ নিয়ম কানুন - "ভালো করে উষ্ণ গরম জলে কয়েক মিনিট ধোয়া" হঠাৎ করে মনে পড়ে আর এদের কাছে জলের অপর নাম যেখানে 'জীবন' আর সব্জি পেট ভরানোর মাধ্যম সেখানে সমস্ত 'অনিয়মই এক বিধিবদ্ধ নিয়ম'।

- রান্নায় ব্যস্ত মহিলার পাশে শিশুটি আপন মনে মা এর হাতে বানানো খালি রুটির স্বাদে খিদে মেটায় ।

- আর রাস্তার উল্টো দিকে তাকাতেই চেনা মুখ ভেসে ওঠে, প্রতিদিনই তো ওদের মুখ দেখে রেডলাইট পার হই তাই মুখগুলো খুব পরিচিত, ওদের 'রেড-লাইট' কারনামা - বাবার বাজানো ঢোলক এর তালে বছর ছয় - সাতেক মেয়ের রিং- জিমনাসটিকস্ শহুরে নামজাদা কোচিং সেন্টারের মুখে ঝামা ঘসে দেয়। ঐ নব্বই সেকেন্ড রেডলাইট বিরতি আর মেয়েটির প্রদর্শন, টেলেন্ট হান্ট এর নামে আমাদের নাকামি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, না হলে এই বিশাল জনসংখ্যার হাতে কেবল গুটিকয়েক 'অলিম্পিক পদক' , প্রশ্নের সম্মুখীন মন, তাহলে খেল নির্বাচকরা কি সারাজীবন তৃতীয় বানরের মত জীবন ভর চোখ বন্ধ করে থাকবে, তাকিয়ে দেখবেনা এদিক, সেদিকে ।

(3)

একটু কষ্ঠ করে চারিদিকে চোখ চেয়ে দেখলেই আমরা 'লক্ষী,' 'সরস্বতী আর 'দুর্গার মতো হাজার, হাজার চরিত্র খুঁজে পাব যারা' শহীদ মিনারের' মত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছে।

ওদিকে' আবার আরো একটা রেড লাইট, খেয়াল করে একবার দেখবেন, এখন আমরা প্রায় সবাই ভালো করে নিজেদের মোহল্লা,গলি, রাস্তা আর পাশের প্রতিবেশী কিংবা খোলা আকাশ দেখার সময় পাই না ।

এই স্মার্ট ফোনের দৌলতে যেখানে বিরতি সেখানেই ফোনের এক অমোঘ আকর্ষণের স্বীকার, হঠাৎ গাড়ির কাচের ঠ্ক ঠ্ক টোকার ধাক্কায় চোখ চেয়ে দেখি সীতা, গীতা কিংবা কাজলদের 'রেড লাইট' 'সেলস প্রোমোশান' খালি গাড়ির মধ্যে ওদের কয়েক সেকেন্ডের পারফরম্যান্স দেখে এখন নিজে নিজেই অনুমান করি কোন কোন গাড়ি ওদের ক্রেতা হতে পারে? এখানে, আর কী জিনিসটাই না পাওয়া যায় বাচ্চাদের খেলনা, বুড়ো, বুড়ীদের- কোমরের ব্যথা রোধক চাইনিজ মেশিন, পড়ুয়াদের- বিভিন্ন পেশাগত বই কিংবা টিনএজারদের সবচেয়ে পছন্দের 'গোলাপ ফুল' ।

এদের কাছে প্রতিটি রেড লাইট মানে 'থামা' নয় আগে বাড়ার নাম কারন আপাত থামা আক্ষরিক অর্থে বাঁচার রসদ যোগায় প্রতি মুহূর্তে দিন -দিন, প্রতিদিন ।

আমাদের দেশ ধার্মিক দেশ, আস্থার দেশ যেখানে প্রতি দিনই ধার্মিক তীর্থ স্থল অসংখ্য মানুষের ভীড়ে সড়গরম করে সেখানেই এত ভেদাভেদ, অসহিষ্ণুতা আর উঁচু - নীচ বোধ তা ভেবেই মন খারাপ হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় দিন দিন এই সোনার দেশে কি করে কিছু স্বার্থান্বেষী বাবা মৌলবিরা তাদের প্রসার যে হারে বাড়িয়ে চলেছে তা সত্যিই আশঙ্কাজনক ।এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির রাস্তায় 'ওলা' পৌঁছে গেল বুঝতেই পারিনি 'ড্রাইভার মুখ ঘুরিয়ে বলল স্যার পৌঁছে গেছি !

ছেলেটা নাম- 'জিগর' রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠার অনুঘটকের কাজ করতো, নিষ্পাপ শিশু, বয়স বছর ৭-৮ হবে হয়তো রোজ ডাস্টবিনের কূড়া নিয়ে যায় আমাদের গলী থেকে, রোজ তিন তলা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে ক্লান্ত বোধ করতো দু-দন্ড জিরিয়ে নিত একদিন গেটের জানালার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখে ফেলি ।

পরের দিন সকালে ওর জন্য বিস্কুট আর জল নিয়ে অপেক্ষা... ওকে বললাম একটু জল আর বিস্কুট খাবি!

- কি ইতস্ততঃ ভাব, বলল কেউ কোনদিন এরকম তো বলেনি তাই !

ওর ছেঁড়া, ময়লা জামার ফাঁকে ' হৃদয়ে ধ্ক' - ধ্ক' আওয়াজ বোঝা যায় ।

এইভাবে আমি ওর জন্য বিস্কুট বা অন্য খাবার নিয়ে তৈরি থাকতাম, এখানকার (দিল্লি শহরের কথা বলছি) প্রতিটি বাড়ি একে অপরের দেওয়াল দিয়ে তৈরি ফলে ঝুঁকে দেখলে ওর গতিপথ সহজে দেখা যায়, আমাদের শহুরে মানুষের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো, ভাবতে অবাক লাগে প্রত্যেক জন যেখানে 'হ্যাপি উইক - এন্ড' মানাতে ব্যাস্ত বিদেশী মোদিরার চুমুকের উল্লাসে আর প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার টাকার, যেখানে ডিজাইনার পোশাকের ভরমার সেখানে ডাস্টবিনের ৫০ পয়সা কভার কেনা তাদের কাছে বিলাসিতা বলে মনে হয় ।

না হলে, 'জিগর'কে প্রতি দিনই শরীর অসুস্থ করে কুড়া তুলতে হতো না, একটা জিনিস লক্ষ্যণীয় দিন দিন এ শহরে মানুষ জনের সাধারণ জ্ঞানের ভান্ডারে জং ধরা শুরু হয়েছে ।

(4)

বেশ কিছু দিন পর ওকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম তোর পরিবারের সদস্যদের পরিচয় কি?

- একটু সময় নিয়ে বলল দুই বোন' আর মা' এর যৌথ সংসার যেখানে তীব্র দারিদ্র্যতা বাঁসা বেধে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে ।

কিছু বলার আগেই ও বলল 'আব্বার ইন্তেকাল বহু বছর আগেই হয়েছে, বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে ও একা সেই ছোট্ট বয়স থেকে সংসারের হাল ধরে নিতে হয়েছে নিজের' স্বপ্নের গলা টিপে, ওর দিন শুরু হয় ভোর চার- টায় ঘোড়ার আস্তাবল পরিচর্যা দিয়ে এর পর ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে বাবুদের গাড়ি ধোয়ানোর কাজ এরপরই শুরু হয় কুড়া ফেলার কাজ বাড়ি, বাড়ি ঘুরে, পরে- চলে কুড়া ছাটাই এর কাজ আর এরই ফাঁকে একবার 'চা' এর বিরতি এ এক অদ্ভুত জীবন জিজিবীষা ।ঠিক যেন একটা জীবন কাহিনী যার মুল্য কেবলই শূন্য ছাড়া আর কিছুই নয় ।

দু'ই বোনের জীবন আগে বাড়ানো আর আম্মিজান এর পাশে বটবৃক্ষ হয়ে দাঁড়ানো যেখানে একমাত্র লক্ষ্য সেখানে শৈশবের কাহিনী ওর কাছে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয় আর স্কুলের রাস্তা ওর কাছে অচেনা, পরিত্যক্ত জায়গায় ছাড়া আর কিছুই নয় ।

অফিস থেকে ফিরে 'চা' এক কাপ খেয়ে টিভির সামনে নিউজ চ্যানেল রেখে কখন যে এক সান্ধ্যকালীন বাস্তব স্পনের কাহিনী মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম তা আর খেয়ালই করি নি।

ঘোর কাটলো নিউজ চ্যানেলের পরিসংখ্যানে যা শুনলে আপনাদের খোলামুখ বোধহয় বন্ধ হবেনা.....

এক নাগরিকের তোলা প্রশ্নবানে জেরবার প্রশাসন- 'এদেশের সবচেয়ে বেশি 'কোরাপস্ ন' কোন শ্রেণীতে শুনলে বিস্মিত হতে হয় ! আমাদের দেশের প্রায় ৪৭%লোক প্রতি মাসে যে টাকা আয় করে সেই টাকাই ফিরিয়ে দেয় দিনযাপন খরচের মাধ্যমে আর গড়পড়তা যেখানে ৫-৬% আয় বৃদ্ধির হার সেখানে এমন এক সম্পদায় আছে এদেশ যাদের এই আয় বৃদ্ধির হার প্রায় ৩০-৪০%??

এও কি সম্ভব?

আর যারা দেশ সেবার নামে দেশের কষ্টার্জিত টাকার দূঃপ্রয়োগ করে 'বিজনেস ক্লাসে ' বিমান চড়ে আর দেশ সেবার 'নামাবলী' ওড়ে আদের কাছে 'লক্ষ্যী,' 'সরস্বতী কিংবা 'জিগর' এর প্রতিদিন তিল তিল করে জোড়া অর্থের কি কোন মুল্য আছে, কি মনে হয় আপনাদের? !!

====সমাপ্ত ====