পিতার অনুভূতি
সমীর সিন্ হা
'জীবনের' অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছি, অনেক ওঠা পড়া, দুখ, সুখের মধ্যে জীবন তরী তর তর করে এগিয়ে চলেছে, 'বিশ্বযুদ্ধ' আর 'স্বাধীনতা' ছাড়া বাদ বাকি প্রায় সবই এই জীবনের অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী, কথায় বলে না, 'অভিজ্ঞতায় প্রবীণ আর বয়সে নবীন' ।
সেই ছোট্ট বয়স থেকে একটা কথা শুনে আসছি, 'মানুষ সামাজিক জিব'।
সত্যিই কি তাই? প্রশ্ন' টা আজও বুঝতে পারি নি যদি আপনারা পারেন প্লিজ একটু বলবেন?
আরও একটা কথা হল 'মাতা- পিতা' আমাদের 'ভগবান' যাদের দর্শনে এ জীবন স্বার্থক যাদের কোমোল স্পর্শে পাপী মুক্তি পায় তাহলে একটা সমীকরণ কেন মেলেনা একটু কষ্ট করে যদি 'বৃদ্ধাআশ্রমের' তালিকাটা দেখা যায় বোধ হয় আমার দেশ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে, তাই প্রশ্ন জাগে মনে একেমন 'ভগবানে' আস্থা যেখানে 'ভগবান' সয়ং পালিয়ে বেড়ায় পরিবার থেকে পরিবারের একটু ভালোবাসার খোঁজে.....
একটা কথা, ধ্রুব সত্য 'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে' তবুও আমাদের স্মৃতিতে জং পড়ে বড় তাড়াতাড়ি না হলে ভগবানের মনে এ কেমন অচেনা আসঙ্কা?
যখন - আমি বুড়ো হয়ে যাবো, একেবারে 'থুত্থু'রে' তখন একটু আমার পাশে থাকবি? একটু বেশি করে ধৈর্য ধরে রাখবি আমার ওপরে? কারণ যদি হঠাৎ তোর দামী কাচের বাসনটা আমার হাত থেকে পড়ে যায় কিংবা, তরকারির বাটিটা উল্টে ফেলি টেবিলের উপরে? চোখের দিসাটা তো তখন একেবারেই কমে যাবে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসবে ঠিক করে ঠাওর ও করতে পারবো না রে! প্লিজ আমাকে তুই চিৎকার করে তখন বকিস না সবার সামনে, হয়তো বা খাওয়ার সময় টেবিল ম্যানার করতে পারবো না, ড্যাইনিং টেবিলের কভারটাকে বারে বারে ধুতে যে হবে তোদের যেমনটা তোর বাচ্চা বেলায় পোশাক চেঞ্জ করাতাম মিনিটে - মিনিটে ।
- বুড়োরা যে সারাক্ষণ নিজেদেরই করুণা করতে থাকে, তুই জানিস না!
- বুড়োদের তো হাজারো অভিযোগ, বিশেষ করে যখন আমি কানে কম শুনতে পাবো, একবারে বুঝে ফেলবো না তুই কী বলছিস, তাই বলে আমাকে ‘বধির’ বলে ডাকিস না! জানি ঔ সময় অনেক কষ্ট হবে তোদের না হয় আরেকটাবার কষ্ট করে কথাটা বলিস, না হয় লিখেই দিলি কাগজে কলমে, তার বদলে মুখ বাঁকিয়ে মুখ ফেরাবি না অনেক কষ্টে তোকে আমরা মানুষ করেছি, আমাকে ক্ষমা করিস রে, আমি যে বুড়ো হচ্ছি!
আজকাল রোগ শোক তো আর বলে কয়ে আসে না 'পারকিনসন়্' এর মতো যদি রোগ হয়ে যায় যখন আমার হাঁটু কাঁপবে, পা দুটো শরীরের ভার আর বইতে চাইবে না, আর যখন দেখবি কোথাও গেলে স্টেশন খালি শুধুমাত্র আমরাই ধীরে ধীরে চলছি 'সবার অবাক জলপান হয়ে' তাকিয়ে তুই একটু ধৈর্য্য ধরে আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবি কি না, বল? যেমন করে প্রথম হাঁটতে শিখেছিলি আমার পায়ের পাতার উপরে দাঁড়িয়ে, তেমনি করে?
- 'হ্যা' রে, তোর মনে আছে কখনও কখন আমাদের রেকর্ড প্লেয়ারটা বাজতো না এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে যেত তেমনি আমি ভাঙা রেকর্ড প্লেয়ারের মত বকবক করেই যাবো, তুই একটু শুনিস কষ্ট করে। আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করিস না মনেমনে আর , আমার বকবকানিতে অধৈর্য হয়ে যাস না রে। তোর মনে আছে, ছোট্টবেলায় তুই একটা খেলনার জন্য কেমন বক বকর করেই যেতিস আমার কানের কাছে, যতক্ষণ না তোকে আমি সেটা কিনে দিতাম?
(2)
- মাঝেমধ্যে আমার সাথে ব্যাংক-এ যাস খুব একা বোধ করি যে দিন থেকে তোর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আর আড় চোখে আমাকে ধমকাস না ম্যানেজারের সই মেলানোর সময় কারন সই এখন মেলে না হাতের কাঁপুনিটা বড্ড বেড়ে গেছে! ।
- খালি বড় বাড়িতে বড় একা লাগে ফোন পাশে রাখা তবু বড় ভয় হয় করতে পাচে মিটিং এর মাঝে তোকে ডিস্টার্ব না করে ফেলি, তপ্যসা করে চলি তোর ফোনের কথা ভেবে।
বুড়ো হয়ে গেলে বোধ হয় এটাই স্বাভাবিক যখন বাড়ির সবাই করুনার সঙ্গে সমঝোতা করে।
- প্লিজ, আমার ঘরে লক্ষনরেখা টেনে দিস না যাতে করে বেরুতেই যেন না পারি, ঘরে ঢুকে পাশে বসিস সেই ছোট্ট বেলায় যেমন জড়িয়ে ধরতিস সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কাহিনী শোনানোর জন্য, জানি আমার এখন সারা গায়ে বুড়ো বুড়ো গন্ধ সাবান মেখে স্নান করার জন্য জোর করিস না আমার শরীরটা যে বড্ড দুর্বল থাকবে, একটু জল লাগলেই ঠাণ্ডা লেগে যাবে! আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিবিনা না কিন্তুু ? মনে আছে, ছেলেবেলায় তোর পেছনে আমি আর তোর মা বাড়ি মাথায় করে ছুটতাম আর ছুটতাম তুই স্নান করতে চাইতিস না বলে?
- তাই বলে আমাকে বকাবকি করিস না বুড়োদের একটু শিতকাতুরে ভাব বেশিই হয় চট করে হুটহাট সবকিছু করতে পারে না তোদের মতন, তুইও বুঝবি একদিন..... বুড়ো হওয়ার কি জ্বালা!
আমরা, যখন জীবন শুরু করি ভালো করে বুঝতে পারিনি এই তোদের 'কেরিয়ারের' মানে ঠিক কি? তা বোধহয় এখনও বুঝি না, শত চেষ্টা করলেও তুই আমার সঙ্গে থাকবি না 'ঘর' তোকে ছাড়তেই হবে যখন বাড়ি আসবি, একটু বেশি সময় নিয়ে আসিস,
- আমরা একসাথে গল্প করবো, কেমন? হোক না মাত্র কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। আমি তো সারাদিন একাই থাকি, আমার সময় যে একা ফুরোয় না। আমি জানি, তুই তোর কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকবি, আমার বুড়ো হয়ে যাওয়া গল্পগুলো তোর শুনতে ভালো না লাগলেও একটু আমার পাশে থাকিস? তোর মনে আছে , কতবার তোর আবল তাবল গল্প আমি শুনতাম, শুনেই যেতাম? আর তুই বলেই যেতিস, বলেই যেতিস 'বাগ ছুটছে গুলি ছুটছে':' বাগ ছুটছে গুলি ছুটছে'।
মানুষের জীবনে কখন যে কি ঘটনা ঘটে যেতে পারে তার খবর কেই বা জানে আর বেঁচে থাকলে সেই দিন আসবে, বিছানায় পড়ে থাকবো, আমাকে ক্ষমা করে দিস যদি ভুল করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলি, যদি চাদরটা নোংরা করে দেই, আমার শেষ সময়টায় শুধু আমাকে ছেড়ে দূরে থাকবি না, খুব কষ্ট লাগবে ।
- আর শেষ সময়ে একটা ইচ্ছে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিস যেমনটা আমরা বাবা আমায় করত, আমি তোর মাথায় বিনুনী করে দিতাম তোর মাথায় আর আমাকে একটু সাহস দিস যেন মৃত্যুকে আমি নির্ভয়ে আলিঙ্গন করতে পারি!
তোর মায়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আর এক মুহূর্ত ভালো লাগছে না এখানে, কত মান, অভিমান কত গল্প কথা বাকি আছে তোর মা এর সাথে আর ভাবিস না, কানে ফিসফিসিয়ে বলবো, দেখ তোমার সন্তান আমাকে খুব ভালোবেসেছিলি, আমার বুড়ো সময়গুলোতে আমার যত্ন নিয়েছিলি!
আমাদের আশীর্বাদ তোর সাথে সারা জীবন ধরে সহায় থাকবে।
আমাদের দেশ নদ, নদী, দেবী দেবতার দেশ আর যেখানে 'বারো মাসে তেরো পাবন' আর আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে 'আস্থা' সেখানে কেনই বা এত অনাস্থা বা কেইবা এত অসহিষ্ণুতা কারনটা জানা জরুরী তাহলে কি আমাদের গোড়ায় গলদ আছে তা নিয়ে গবেষণা করাও জরুরি ।
(3)
একটা মজার ব্যাপার হল, এই এশিয়া মহাদেশে, আজকের যুগে এমনও দেশ আছে যেখানে প্রতিটি স্কুলে প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে একটি অন্যরকম দিন পালন করা হয়।
স্কুল থেকে ওইদিন সব ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবাকে স্কুলে আমন্ত্রণ জানানো হয়। স্কুলের মাঠে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সব ছাত্র, ছাত্রীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় নিজেদের মায়ের দুই পা জল দিয়ে পরিস্কার করে মুছে দিতে। ছাত্র ছাত্রীরা যত্নের সঙ্গে সেই নির্দেশ পালন করে।
- কিন্তু কেন এই কর্মসূচি ?
ও দেশের ছাত্র, ছাত্রীদের জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই শেখানো হয় যে, ভবিষ্যত জীবনে তারা যেন বাবা-মায়ের যত্ন নিতে ভুল না করে কারনটা সেই একই কথা সব দেশেই প্রযোজ্য 'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে'
আর কি লাভ হলো এইধরনের কর্মসূচিতে ?
শুধুমাত্র, এই শিক্ষার ফলেই আজ পর্যন্ত কোন বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেনি ও দেশে ।
ভাবুন তো, একবার কোন দেশের কথা বলছি?
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই ধরনের সাধারণ ঘটনা নিয়ে আমাদের চিন্তা এখন ও প্রায় আদিম অথচ আমরা এখন নিজেদের আধুনিকতার প্রতীক ভেবে দিব্যি দিন কাটিয়ে যাচ্ছি ।।
- - - সমাপ্ত - - -